সে এবার চোখ ফিরিয়ে দেয়ালে টানানো আমাদের পুরোনো ছবির দিকে তাকায়, কিছু বলে না। সব বলা যেন আমার একার।
ঘোর অসুস্থতায় যখন পৃথিবীর কোনো খবরাখবরে আমার কিছুই যায় আসছে না, ঠিক তখন সে এসে পাশে বসল বহুদিন পর। তাকে দেখে অসুস্থতা ভুলে অভিমানে মন ভারী করে ফেললাম। ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম, ‘এত দিন পর! এত দিন পর মনে পড়ল আমার কথা?’
সে চুপ করে বসে রইল। মৃদু হাসি দিল। তারপর অপলক চেয়েই থাকল। বললাম, ‘কত দিন পর এলে, মনে আছে?’
সে তা-ও কোনো উত্তর দিল না। মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বললাম, ‘আজ ১৬ মাস ২০ দিন পর এলে। এত হৃদয়হীন মানুষের সঙ্গে আমার ২৬ বছরের সংসার ছিল, ভাবতেই অবাক লাগে।’
সে এবার চোখ ফিরিয়ে দেয়ালে টানানো আমাদের পুরোনো ছবির দিকে তাকায়, কিছু বলে না। সব বলা যেন আমার একার। তার কোনো কথা নেই। কোনো আফসোস নেই। আমাকে ছাড়া সে যেন ভীষণ ভালো আছে।
ধীরে ধীরে গলা ভারী হয়ে আসে। ভারী গলায় বলতে থাকি, ‘তুমি এত কাণ্ডজ্ঞানহীন, হৃদয়হীন মানুষ জানলে তোমার হাত ধরতাম না। ২৬ বছর আমার ভ্রমে কেটে গেছে। ভেবেছিলাম, তুমি ভালো মানুষ, আমার পাশে আজীবন থাকবে, আগলে রাখবে। অথচ তুমি কিনা...।’ আমি আর বলতে পারি না। অঝোরে কাঁদতে থাকি। এত কান্না দেখেও মানুষটার কোনো বদল ঘটে না। সে আবারও মায়াভরা দৃষ্টিতে আমার কান্না দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমি বলি, ‘আমাকে কাঁদাতে এত ভালো লাগে তোমার? এ কেমন তুমি? তোমাকে আমি চিনি না। তুমি আমার কেউ হও না। যাও, তুমি যাও।’ আমার বাঁধভাঙা কান্না যেন থামতে চায় না। আর তার তাকানোরও শেষ হয় না। পাশে বসে ঠোঁটে আলতো হাসি এঁকে সে তাকিয়ে থাকে। মায়াময় সে চাহনি।
তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সেটা করছি না। জড়িয়ে ধরতে গেলেই আমার ঘোর কেটে যাবে। তারপর সে আবারও চোখের আড়ালে চলে যাবে। তার চেয়ে বরং এভাবেই বসে থাকুক, যতক্ষণ ইচ্ছা হয়। আমি না হয় তাকে আজন্মের মতো ছুঁয়ে দেখার বাসনা বিসর্জন দিলাম।
কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছো?’ কোনো উত্তর নেই। আবারও বলতে লাগলাম, ‘একা থাকতে কেমন লাগে? ইচ্ছা হয় রোজ সন্ধ্যায় সারা দিনের গল্প নিয়ে বসতে? ইচ্ছা হয় প্রিয় বই ছুঁয়ে দেখতে? পাতার ঝোল খেতে মনে সাধ জাগে? বলো না কী কী ইচ্ছা হয়? নাকি তুমি পাথর হয়ে গেছ, কোনো ইচ্ছা আর হয় না তোমার?’
সে এবার মৃদু স্বরে হাসে। তারপর খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে; যাতে আমি বুঝতে না পারি তার অন্তরের হাহাকার।
মানুষটার জন্য ভীষণ মায়া হয়। এত মায়া হয় যে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমিও ভালো নেই তোমায় ছাড়া। এই তো আর কটা দিন, মাস বা বছর, আমিও চলে আসব তোমার কাছে। পৃথিবী আমার কাছে এখন বিষণ্ন একটা জগৎ। যেখানে তুমি ছাড়া কোনো আনন্দ নেই, সুখ নেই। তোমার স্মৃতিতে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি।’
তার চোখের কোণে জমে অশ্রু। আনমনে তার গাল ছুঁতে হাত বাড়াই। অথচ তাকে আমার ছুঁয়ে দেখা আর হয় না। ঘোর কেটে যায়, সে-ও চলে যায়। আমার একলা প্রহর কেটে যায় আর্তচিৎকারে। তাকে আর একটিবার ছুঁয়ে দেখতে না পারার অসহনীয় ব্যথায়।
এ জীবন এত অভিশপ্ত, এত করুণ, এত মায়াহীন হবে জানলে স্রষ্টাকে বলে রাখতাম, যাতে আয়ুরেখাটা একই দিনে শেষ হয় আমাদের। মন খারাপের অসুখ হয়েছে আমার। এ যেন এক অন্তহীন তুমি শূন্যতার অসুখ, যা আজন্মের জন্য দিয়ে গেছ। আর আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। বয়ে বেড়াব যত দিন বাঁচি।
বন্ধু, সিলেট বন্ধুসভা