অভিমান

অলংকরণ: তুলি

নিয়ম করে ওষুধ খেয়ে নিয়ো, নিজের ওপর একটুও অবহেলা কোরো না কিন্তু; শাসনের সুরে আমায় যখন এগুলো বলতে তুমি, খুব ভালো লাগত আমার। আমাকে নিয়ে কেউ একজন ভাবে তাহলে!

নিজের ওপর অবহেলা করাটা আমার পুরোনো অভ্যাস ছিল। জীবনে তুমি আসার পর নিজেকে নিয়ে ভাবিনি। কারণ, আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য তুমি তো ছিলেই। হুটহাট করে ঠান্ডা লেগে গেলে রোজ অন্তত ১০০ বার জিজ্ঞেস করতে শরীর ঠিকঠাক তো? আমার সঙ্গে একটা মানুষ থাকলে শরীরের বারোটা বাজার আর সুযোগ কোথায়!

কিন্তু নিজের ওপর অবহেলার ভার তো নিজেকেই সইতে হবে। দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়ার পথে তুমি। আমিও সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলাম। আগের মতো তোমার প্রতি আমার আবেগ, অনুভূতি, তোমাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন—সবটা তোমাকে বলা বন্ধ করে দিলাম। অবশ্য তুমি নিজে থেকে শুনতে চাওনি, আর আমিও আগ বাড়িয়ে বলিনি কিছু। তাই এখন নিজেকে নিজের মনের কথা বলা শুরু করলাম।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলতাম, ‘তুমিই এই জগতের ঢাল, তোমাতে দেখি মুখ ভবিষ্যতের হাল। অঙ্গের কালি নিবারণ করো সামনে তা এনে, সাজাও সবে নিদারুণভাবে আলো নয়নে।’ বইয়ের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে রোজ কাঁদতাম। সবটা তোমাকে বলতে গিয়েও রোজ ফিরে আসতাম। একদিন দেখি, পরিবারের সবার মুখের হাসি নিশ্চুপ হয়ে গেল; মাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কিছুতেই বলতে চাচ্ছে না। তবু জেনে গেলাম, এই মায়ার শহরে আমি আর বেশি দিন নেই। ভাবলাম, কত্ত বোকা আমি, নিজের ভালোবাসার জন্য পরিবারের ভালোবাসার কথা ভুলেই গেলাম। স্বার্থপর মনে হতে লাগল নিজেকে।

কিন্তু তোমার ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে আমাকে অবহেলা করার কথা ভুলতে পারছিলাম না কিছুতেই। আমি বরাবরই অনেক জেদি। ধীরে ধীরে সময়ের আগেই যেন সময় ফুরিয়ে আসতে লাগল। অনিয়ম করে ওষুধ আর নিজের প্রতি অযত্ন যেন আমাকে মিলিয়ে নিচ্ছিল। অতঃপর হাসপাতাল যেতে হলো; ভর্তিও নিল ওরা। পরিবারের সবার ভালোবাসা, সাহস আর নার্সদের যত্নে কিছুটা সুস্থ। কিন্তু মনের যত্ন মানসিক শান্তির জন্য তখনো আমার তোমাকেই চাই। পরক্ষণেই মনে হলো, ভুল মানুষের কাছে ভুল আবদার করাটা অসম্মান, নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুই নয়। দিন দিন শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগল।

এর কিছুদিন পরের ঘটনা, বিকেল তখন পাঁচটা প্রায়। তুমি এলে আমার সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে। সাতপাঁচ না ভেবেই জড়িয়ে ধরলে আমায় আর কাঁদতে কাঁদতে বললে সরি...। কী বলব, বুঝে ওঠার আগেই আমার চোখে পানি চলে আসে। নিমেষেই ভুলে গেলাম আমাকে দেওয়া তোমার কষ্টগুলো। তুমি খুব করে কাঁদলে আর বললে, তুমি সবকিছু ঠিক করে দেবে, আবার সব আগের মতো হবে। তোমার শুধু আমাকে চাই। তুমি কাঁদছ; আমিও নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। তখন মনে হচ্ছিল, জীবনটা এখানেই যদি থমকে যেত!

তোমাকে আমার অসুস্থতার কথা কে বলেছিল, জানি না। কিন্তু যেই বলুক, খুব অন্যায় করেছে সে। তোমার অপ্রত্যাশিত আগমন আর অনুশোচনা আমাকে আরও হাজার বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগিয়ে দিয়েছিল সেদিন। তুমি যখন এই কাগজ হাতে পাবে, তখন হয়তো আমি আর থাকব না এই পৃথিবীতে। কষ্ট পেয়ো না দয়া করে।