‘রাতে ঘুমে সমস্যা হচ্ছে, সকালে উঠতে পারি না’

ইউনিমেড ইউনিহেলথের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলো ট্রাস্টের সহযোগিতায় এবং বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের আয়োজনে দেশব্যাপী চলছে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক কর্মশালা। এরই মধ্যে মোট দুই ধাপে ১৫টি স্থানে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালা শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক সাড়া পড়েছে। অনেকে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নানা প্রশ্ন করছেন। তার মধ্য থেকে আজ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ঢাকা সিটি হাসপাতাল লিমিটেডের সাইকোথেরাপিস্ট কনসালট্যান্ট মাহমুদা মুহসিনা বুশরা

প্রতীকীফাইল ছবি

প্রশ্ন-১: কারও মন খারাপ হলে বা কোনো চাপে থাকলে তিনি যদি একা থাকতে চান, তাহলে কী তাঁকে একা থাকতে দেওয়া উচিত? যদিও তিনি একা নিজেকে সামলাতে পারেন না, আরও বেশি চাপ অনুভব করেন। কিন্তু তিনি কারও সঙ্গে তাঁর চাপ বা কষ্টের কারণটাও বলতে চান না। এই পরিস্থিতিতে আমি বন্ধু হিসেবে কী করতে পারি?

আয়শা (ছদ্মনাম), বয়স ২১ বছর

উত্তর: কেন মন খারাপ বা চাপ বোধ হচ্ছে, সেই বিষয়টা আগে জানার চেষ্টা করা। যদি তিনি বলতে চান, তাহলে সেটা শোনা। তখন একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আপনি সেভাবে ব্যবস্থা করতে পারবেন। একা থাকাটা সব সময় খারাপ নয়। এই সময়টা একা থাকতে চাওয়া হতে পারে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া, নিজের অনুভূতির সঙ্গে থাকা। তবে আপনি খেয়াল রাখবেন, এমনভাবে যেন তিনি সন্দেহ না করেন বা বিরক্তি অনুভব না করেন। যেহেতু আপনি বলছেন, একা নিজেকে সামলাতেও পারেন না। এমতাবস্থায় আপনি তাঁকে প্রশ্ন না করে, বিরক্ত না করে শুধু সঙ্গে থাকবেন। এটা জরুরি। সময় দিবেন কিছুটা। আপনাকে বলতেও পারেন। আর সময় বুঝে পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। গেলে কী উপকার হবে, তা বুঝিয়ে বলতে পারেন।

প্রশ্ন-২:  কিছু দিন ধরে আমার পড়ালেখা মনে থাকে না। পড়তে বসলেই মাথার পেছন দিকে ব্যথা করে। মাঝেমধ্যে পড়তেও ইচ্ছে করে না।

আমেনা, বয়স ২০ বছর

উত্তর: একটু খেয়াল করা, প্রথমত আপনার শারীরিক কোনো সমস্যা আছে কি না। মাথাব্যথার কী কারণ, তা একজন ডাক্তারের কাছে গিয়ে জেনে নেওয়া।

তারপর একটু খেয়াল করা, আপনার দৈনিক কার্যক্রমের দিকে। আপনি কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন, বিনোদনের জায়গা রেখেছেন কি না। অতিরিক্ত কোনো বিষয়ে চাপ নিচ্ছি কি না। দায়িত্ব, পড়াশোনা, রেজাল্ট বা পারিবারিক কোনো বিষয়, বন্ধুদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কে সমস্যা যাচ্ছে কি না। যদি থেকে থাকে, তাহলে সেগুলোর সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া। নিজে না পারলে, কাছের কেউ যাঁকে আপনি নির্ভর করেন, বিশ্বাস করেন, তাঁর কাছে যেতে পারেন। পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে পারেন।

তারপর আর একটু খেয়াল করতে পারেন, যে বিষয়টি নিয়ে পড়ছেন, তা আপনার পছন্দের কি না। মনে না থাকার বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। কোনো বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। এক নাগারে না পড়ে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে পড়তে পারেন। একটু গান শুনতে পারেন। খেয়াল করবেন, বেশি চাপ দিচ্ছেন কি না নিজেকে। হয়তো পড়ছেন ঠিকই, ভয় হচ্ছে যদি মনে না থাকে! এমনও হতে পারে শুধু পড়া পড়াই করছেন। তাহলে আগ্রহ বা মজা কিছুই থাকবে না। ঘুম ঠিক মতো হচ্ছে কি না, এটা বিশেষ জরুরি।

প্রশ্ন-৩:  কিছুদিন যাবৎ আমি কোনোভাবেই পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছি না। পড়তে বসলেই অস্থিরতা কাজ করে। পড়তে ইচ্ছে করে, না পড়লে অনুশোচনা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই পড়াশোনায় মন টিকাতে পারি না।

মালিহা (ছদ্মনাম), বয়স ২০ বছর

উত্তর: কিছুদিন যাবৎ যেহেতু বলছেন, সেহেতু আপনি আগে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারতেন। একটু ভাববেন, কী ঘটেছে আসলে বিষয়টিতে? হতে পারে আপনার জীবনের, হতে পারে পড়াশোনা নিয়ে অতিরিক্ত চাপ, দৈনিক রুটিনে কোনো পরিবর্তন (যেমন ঘুম, খাওয়া, বন্ধু, আড্ডা) দৈনন্দিন জীবনের পরিবর্তন বা কোনো চাপ, পারিবারিক কোনো চাপ বা কোনো ধরনের রিকগনিশন পাচ্ছেন না, বা আপনার পছন্দের বিষয়টি নিয়ে পড়ছেন কি না। একটু খেয়াল করবেন, পড়তে বসার সময় কী চিন্তাটা ওই মুহূর্তে কাজ করে। সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারেন।

অনুশোচনার হয় বলেছেন, না পড়তে পারলে। আপনার অবস্থা আমি অনুভব করতে পারছি। একটু খেয়াল করবেন, আপনি অনেক ক্লান্ত কি না। সম্ভব হলে নিজেকে একটু বিশ্রাম দেওয়া যায় কি না। বিশ্রাম নিতে গেলে আবার অপরাধবোধ হতে পারে যে সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওই জায়গাটায় নিজেকে আশ্বস্ত করা। আপনি একটু বিশ্রাম নিতেই পারেন। গভীর নিশ্বাস নিতে পারেন চার থেকে পাঁচ বার। একটু থেমে থেমে। নিশ্বাসটা টেনে ধরে উপরে বুক পযর্ন্ত কিছুক্ষণ রেখে মুখটা হা করে ছেড়ে দিতে পারেন ধীরে ধীরে। একটা অস্থিরতা কাজ করছে বুঝতে পারছি। এতে অস্থিরতাও কমে আসবে।

আর পড়াশোনার ক্ষেত্রে পদ্ধতিতে পরিবর্তন করে দেখতে পারেন। আপনার উদ্দেশ্য পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া যদি হয়ে থাকে, তাহলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, কী চান আপনি। ভেতরের যে আমিটা, তাকে প্রশ্ন করুন। সে আপনাকে উত্তর বলে দেবে। নিজেকে বিচার না করে, তার প্রতি ভালোবাসা রেখে কথা শুনুন।

প্রশ্ন-৪: কিছুদিন ধরে আমার ঘুমে সমস্যা হচ্ছে। রাত ১১টায় ঘুমাতে গেলে ভোর ৫টার দিকে ঘুম ধরে। মাথায় চাপ অনভূত হয়। কিন্তু সকালে উঠতে পারি না।

সাবিলা (ছদ্মনাম), বয়স ২০ বছর

উত্তর: আপনি বলেছেন কিছুদিন ধরে হচ্ছে এ সমস্যা। তার মানে আগে ঘুমাতে পারতেন।

প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি আসলেও ঘুমাতে চান কি না। যদি চান, তাহলে আপনি কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন ঘুমানোর জন্য, তা খেয়াল করুন। কোথাও কোনো বিষয়ে গ্যাপ আছে কি না। বলছেন রাত ১১টায় আপনি ঘুমাতে যান। ঘুম আসে ভোর পাঁচটায়। আপনি যে জেগে থকেন, তখন কী কী করেন? মোবাইলে কিছু করেন কি না। হতে পারে কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। এই বিষয়গুলো দেখা। আর মাথায় চাপ কেন হচ্ছে, একটু ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া, অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না। এই বিষয়গুলো দেখার পর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে পারেন—

* বিকেলের পর থেকে চা বা ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল–জাতীয় কিছু পান করব না।
* রাতে অন্তত ঘুমের চার ঘণ্টা আগে খাবার খাবেন।
* তৈলাক্ত বা আপনার কোনো খাবার হজমে সমস্যা থাকলে, তা খাবেন না।
* সময়টা ঠিক করে নেওয়া; কখন বা কয়টায় ঘুমাতে চান। সেটা অবশ্যই যেন সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতে পারেন, সেভাবে ঠিক করা।
* হাত–মুখ ধুয়ে বা আবহাওয়া অনুযায়ী হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল বা ফ্রেস হয়ে নিতে পারেন।
* ঢিলেঢালা কাপড় বা আপনার আরাম লাগে এমন কাপড় পরে ঘুমাতে যান।
* মুঠোফোন সাইলেন্ট করে দূরে রাখুন।
* রুমটা সম্পূর্ণ অন্ধকার করে নিতে পারেন। একদম অন্ধকার ভালো না লাগলে একটা হালকা ডিম লাইট জ্বলিয়ে নিন।
* বিছানা এবং বালিশ আরামদায়ক কি না, সেটা খেয়াল করবেন।
* হালকা রিলাক্সেজেশন করে চোখ বন্ধ করতে পারেন।
* এসব করার পরও যদি দুশ্চিন্তা আসে, পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে পারেন।