ছন্দের ধরন

বাংলা বর্ণমালা

ছন্দ: ড. সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়ের মতে, বাক্যস্থিত পদগুলোকে যেভাবে সাজালে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তার মধ্যে ভাবগত, ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধি হয়, পদ সাজানোর সে পদ্ধতিকে ছন্দ বলে।

কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, তাকে ছন্দ বলে।

প্রকার: ছন্দ ৩ প্রকার। যেমন—অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। তিন রকম ছন্দকে বুঝতে হলে শুরুতে দু-একটা বিষয় সহজে বুঝে নেওয়া দরকার। যেমন—অক্ষর, মাত্রা, পর্ব।
অক্ষর: শব্দকে ভাঙলে যে ক্ষুদ্রতম ধ্বনিতে বিভক্ত হয় তাকে অক্ষর বলে। যে অক্ষরের উচ্চারণ হসন্তে শেষ হয়, তাকে বদ্ধাক্ষর বলে। যেমন—চল্, কর্, কন্, দিন্ ইত্যাদি। যে অক্ষর হসন্ত ছাড়া শেষ হয় তাকে বলে যুক্তাক্ষর। যেমন—কা, কি, কু, কা, কো ইত্যাদি।
মাত্রা: অক্ষর উচ্চারণের কালকে মাত্রা বলে। ছন্দ নির্ণয়ে মাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পর্ব: একবারে আমরা কবিতার কতটুকু বলি তাই পর্ব। পর্বের ছোট ছোট অংশকে পর্বাঙ্গ বলে।
কোনো কবিতার ছন্দ নির্ণয় করতে হলে প্রথমে তার পর্ব নির্ধারণ করতে হয়। এরপর নিচের নিয়ম অনুযায়ী মাত্রা হিসাব করে কবিতাটি কোন ছন্দে লেখা, তা ঠিক করতে হয়।
স্বরবৃত্তে- মুক্তাক্ষর হলে ১ মাত্রা
             বদ্ধাক্ষর হলে ২ মাত্রা।
মাত্রাবৃত্তে- যুক্তাক্ষর হলে ১ মাত্রা
                বদ্ধাক্ষর হলে ২ মাত্রা
অক্ষরবৃত্তে- মুক্তাক্ষর হলে ১ মাত্রা
                 বদ্ধাক্ষর হলে শুরু ও মধ্যে ১ মাত্রা। শেষে হলে ২ মাত্রা।

ক. অক্ষরবৃত্ত:
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আরও কিছু নাম আছে। তা হচ্ছে—
অক্ষরমাত্রিক, বর্ণমাত্রিক। অক্ষরবৃত্ত নামটা দিয়েছেন প্রবোধচন্দ্র সেন। তিনি একে যৌগিক ছন্দও বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ একে কখনো বলেছেন সাধুছন্দ, কখনো বলেছেন পয়ারজাতীয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
১. এ ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ, তত মাত্রা।
২. প্রতিটি অক্ষরই এখানে একটি মাত্রার মর্যাদা পেয়ে থাকে।
উদাহরণ:
১. নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন। ২. কাঁপে তারা কাঁপে ঊরু গুরুগুরু করি। ৩. চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির।
এখানে প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে অক্ষর যেমন চৌদ্দ, মাত্রার সংখ্যাও তেমন চৌদ্দ। তার মানে এই নয় যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতার প্রতিটি লাইনে ১৪টি অক্ষর থাকতে হবে। অক্ষরের সংখ্যা বাড়লে মাত্রার সংখ্যাও বাড়বে। বিপরীত দিকে অক্ষরের সংখ্যা কমলে মাত্রার সংখ্যা কমবে। এককথায় অক্ষর ও মাত্রা সব সময় সমান থাকবে।

খ. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:
মাত্রাবৃত্ত নামটিও প্রবোধচন্দ্র সেনের দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ একে সংস্কৃত-ভাঙা ছন্দ বলতেন।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
১. এই ছন্দ হবে মূলত ধ্বনিপ্রধান।
২. মাত্রাবৃত্তের পর্বগুলো কখনো ৪ মাত্রার, কখনো ৫ মাত্রার এমনকি ৬ বা ৭ মাত্রার হতে পারে।
উদাহরণ:
১. এবারে এসেছে কার্তিক; তার
            উত্তুরে বাতাসের
   বরফে-ডোবানো দন্তের ধার
           রাত্তিরে পাই টের।
২. বরষার নির্ঝরে অংকিত কায়
দুই তীরে গিরিমালা কতদূর যায়।
৩. গর্জনে কাঁপে মাটি, ট্রেন ছুটে যায়
    আতঙ্কে গরুগুলো দিগন্তে ধায়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রে প্রতিটি অক্ষর তো এক মাত্রার মূল্য পায়ই, যুক্তাক্ষর পায় দুই মাত্রার মূল্য। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘ঐ’ আর ‘ঔ’–এর কথা। এরা শব্দের আদি-মধ্য-অন্তে যেখানেই থাক, মাত্রাবৃত্তে তারা দুই মাত্রা আদায় করবে।

গ. স্বরবৃত্ত ছন্দ:
স্বরবৃত্ত নামটিও প্রবোধচন্দ্রই দিয়েছেন। তবে মৌলিক ছন্দ নামেও তিনি একেই বোঝাতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সে ক্ষেত্রে এই ছন্দকে বলতেন ‘বাংলা প্রাকৃত’। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বলতেন শ্বাসাঘাতপ্রধান ছন্দ।
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
১. স্বরবৃত্তের ক্ষেত্রে প্রতিটি সিলেবলকে একটি করে মাত্রার মূল্য দিতে হয়।
২. সাধারণ নিয়মে প্রতিটি পর্বে চার মাত্রা থাকবে।
৩. পর্বের শুরুতে ঝোঁক পড়ে।
৪. এ ছন্দের লয় দ্রুত। মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষর উভয়ই সমমূল্য অর্থাৎ ১ মাত্রা।
৫. দ্রুতলয়, চার মাত্রার হিসাব এবং পর্বের শুরুতে শ্বাসাঘাত।
৬. এই ছন্দে ভাষার স্বাভাবিক উচ্চারণরীতি বর্তমান থাকে।
উদাহরণ:
১. একটি কথা নেই মুখে তার
          সঙ্গী বিহীন ঘরে
    রুদ্ধ কথার যন্ত্রণাভার
          অশ্রু হয়ে ঝরে।
২. আহার জমে পরিপাটি
         সত্য বলি ভাই
পলান্ন আর একটি বাটি
       কোর্মা যদি পাই।
৩. অংক কষে কিচ্ছু পেলে
        কাব্য গেল মরে।
আনন্দের কি পরশ মেলে
       ছন্দ বিচার করে।
এবার একটি হৃদয়ঘটিত ঘটনাকে তিনটি ছন্দে তুলে ধরে, খুব সহজে ছন্দ বোঝাতে চেষ্টা করছি—
১. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:
   ঘৃণায় বিঁধেছ যাকে, দিয়েছ ধিক্কার,
আহ্বান জানালে তাকে মিথ্যে কেন আর?
২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:
ঘৃণাতে যাকে বিঁধেছ, যাকে
     বলেছ শুধু ছিছি,
সহসা কেন এখানে তাকে
    ডেকেছ মিছিমিছি?
৩. স্বরবৃত্ত ছন্দ:
ঘৃণা কর যে লোকটাকে
    শুধু বল ছি-ছি,
আবার তুমি কেন তাকে
   ডাকলে মিছিমিছি।

এখন প্রশ্ন হলো—আবৃত্তি করতে হলে ছন্দ বিষয়ে কি খুব ভালো ধারণা থাকা দরকার? ছন্দ ছাড়া কি কোনোভাবেই আবৃত্তি করা সম্ভব নয়?
আমার সরল উত্তর—না। ছন্দ বিষয়ে ধারণা না থাকলেও আবৃত্তি করা যায়, তবে ভালো আবৃত্তি সম্ভব নয়। ছন্দ বিষয়ে জ্ঞান থাকলে যে সাহস নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করা যায়, ছন্দ না জানলে তা সম্ভব নয়।

সিনিয়র প্রভাষক, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ