ধিক্কার

অলংকরণ: তুলি

সন্ধ্যা নেমেছে, বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। অপূর্বর সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। উচ্চতর গণিত দ্বিতীয় পত্র বইটি নিয়ে অঙ্ক করার চেষ্টা করছে, কিছুতেই মন বসছে না। বারবার তৃষার কথা মনে পড়ে!  রাত প্রায় নয়টা। বৃষ্টি থামেনি। এখন বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের বেগ বেড়েছে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর বৃষ্টির ফোঁটা আসছে। অপূর্ব জানালা বন্ধ করতেই বিদ্যুৎ চলে যায়।

হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ফিসফিস করে ডাকে, ভাইয়া, দরজা খোল। আমি তৃষা। অপূর্বর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এত রাতে তৃষা! অপূর্ব দরজা খোলে। অন্ধকার ঘরে তৃষা প্রবেশ করে, সারা শরীর ভেজা। স্কুলব্যাগটি মেঝের ওপর ফেলে দেয়। অপূর্ব ভয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে। কী করবে? টেবিলের ওপর হাতড়াতে হাতড়াতে দেশলাইটি খুঁজে পায়। মোমবাতি জ্বালায়। জিজ্ঞাসা করে, এত রাতে এখানে কেন? পালিয়ে এসেছি। চলো পালিয়ে যাই। টাকার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। এই ব্যাগে এক লাখ টাকা আর মায়ের কয়েক ভরি সোনা আছে।’

অপূর্ব জানে, এটা তৃষার পাগলামি। সে কেবল এইচএসসি আর তৃষা ক্লাস নাইনে। এটা যে সম্ভব নয়। অপূর্বর নিজেরই পেট চলে না। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে মা কোনোরকমে সংসার আর তার পড়ার খরচ চালান। অপূর্ব গামছা এগিয়ে দিয়ে বলে শরীর ভিজে গেছে, মুছে নাও। ব্যাগটি তুলে বিছানায় রাখে, কী করবে উৎকণ্ঠায় ঘেমে যায়। তৃষাকে এক গ্লাস পানি আর বিস্কুট খেতে দিয়ে দরজার বাইরে বের হয়। প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। উপায়ান্তর না পেয়ে তৃষার মাকে ফোন করে। খালাম্মা, আমি অপূর্ব। তিনি হাউমাউ করে কাঁদা শুরু করেন। বলেন, অপূর্ব, তৃষাকে পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তা করবেন না খালাম্মা, ও আমার এখানে এসেছে, বৃষ্টির কারণে বাড়ি ফিরতে পারেনি। তাই ফোন করলাম। ওকে নিয়ে যান।
তৃষা তখন বিস্কুট খেয়ে পানির গ্লাস মুখে তোলে। অপূর্বর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, প্লিজ, আর দেরি করো না। একটি সিএনজি নিয়ে এসো, পালিয়ে যাই। অপূর্ব কিছু বলে না।
মিনিট দশেকের মধ্যে ডা. শফিউল্লাহ ও তার স্ত্রী গাড়ি নিয়ে অপূর্বর বাসার সামনে হাজির। মা–বাবাকে দেখে চমকে ওঠেন তৃষা! চলে যাওয়ার সময় অপূর্বকে ধিক্কার দিয়ে তৃষা বলে, কাপুরুষ! তোমার ভালো হবে না।

পরদিন খুব ভোরে বইপত্র, কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাড়ি চলে যায় অপূর্ব। এরপর আর ছয় মাস আলমগঞ্জে ফেরেনি সে। কেবল ফাইনাল পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই কোচিং–এর জন্য ঢাকায় চলে যায়। তৃষাকে একটি দিনের জন্যও ভুলতে পারেনি।
বাবা নেই। বাবার অবসর ভাতা দিয়ে মা তাকে কষ্ট করে পড়ান। মায়ের ইচ্ছাতেই আলমগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হয় অপূর্ব। মেসে লেখাপড়ার ক্ষতি হতে পারে ভেবে হাউস বিল্ডিংয়ে একটি রুম ভাড়া নেয়। খাওয়াদাওয়া, রুমের ভাড়া ও প্রাইভেটের টাকা দিতে মায়ের কষ্ট হয় ভেবে টিউশনি খোঁজে অপূর্ব। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আলমগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালের এমবিবিএস ডা. শফিউল্লাহর একমাত্র মেয়ে তৃষাকে  মাসে পাঁচ হাজার টাকায় প্রাইভেট পড়াতে শুরু করে। গণিত পড়ানোর জন্য প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় যাওয়া হয়।

অপূর্ব কোনো দিন কোনো মেয়ের এত কাছাকাছি হয়নি। তার ওপর তৃষা সুন্দরী, উজ্জ্বল-ফর্সা, লম্বা হালকা গরন, কাজলকালো চোখ, লম্বা সরু নাক, কমলা রঙের পাতলা দুটি ঠোঁট। একবার দেখলে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। অপূর্ব নাম জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করে, তোমার নাম? মুচকি হেসে তৃষা জবাব দেয়, লাবণ্য মল্লিক তৃষা। প্রথম দর্শনেই তৃষাকে ভালো লেগে যায় অপূর্বর। প্রাইভেট শেষ করে আসার সময় তৃষা জিজ্ঞাসা করে, স্যার, আপনার নাম তো বললেন না। আমার নাম অপূর্ব। তৃষা আবার হাসে।

ছাত্র হিসেবে অপূর্ব খুবই ভালো। দেখতে সুদর্শন। এক মাস যেতে না–যেতেই অপূর্বের প্রতি তৃষার আগ্রহ জন্মে। নির্ধারিত সময়ের আগে আসার জন্য বলে। পড়া শেষে উঠতে চাইলে বলে আর একটু থাকুন না। আপনি থাকলে খুব ভালো লাগে। অপূর্ব হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে, কেন? না, এমনিতেই। আপনাকে আমার স্যার বলতে একদম ভালো লাগে না। কী বলতে ইচ্ছা করে? বলব, অন্য একদিন। অপূর্ব তৃষার ইচ্ছা বুঝতে পারে। অঙ্ক করার সময় সেদিকে না দেখে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কী দেখ? আপনাকে। আমাকে কেন?

পরের দুই দিন অপূর্ব আর পড়াতে আসেনি। তৃষার মা ফোন দিলে সে জানায়, অসুস্থ, শরীরটা ভালো নেই। এ কারণে পড়াতে আসছে না। তৃতীয় দিন আবারও পড়াতে যায় অপূর্ব। অর্থের জন্য টিউশনিটা দরকার। তাই ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে দিনে দিনে তৃষা লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠছে। একদিন অপূর্বকে পালিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে বসে। অপূর্ব ভয়ে প্রাইভেটে আসা বন্ধ করে দেয়। কয়েক দিন পর সত্যিই রাতে পালিয়ে আসে তৃষা।

সেই রাতের ঘটনার পর থেকে তৃষার সঙ্গে আর কখনোই যোগাযোগ হয়নি অপূর্বর। এখন সে শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএস শেষ করে ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতা করছে। অন্যদিকে, তৃষা আবারও লেখাপড়ার মনোযোগী হয়। ঢাকা মেডিকেলে থেকে ডাক্তারি পাস করে বিদেশ থেকে মনোরোগের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসে। এখন সে নাম করা সাইকিয়াট্রিস্ট।

বয়স হলেও এখনো বিয়ে করেনি অপূর্ব। মা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর। একাকী জীবনে শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। আজকাল মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। এক সহকর্মীর কাছে জানতে পারে গ্রিন রোডে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট রোগী দেখে। অপূর্ব মুঠোফোনে ডাক্তারের সিরিয়াল দেয়। মুহূর্ত পরই মুঠোফোনে মেসেজ আসে, সিরিয়াল নম্বর সাত। রোববার বিকেল ৫টায় চেম্বারে উপস্থিত থাকতে হবে।
রোববার যথাসময়ে ডাক্তারের চেম্বারে চলে যায় অপূর্ব। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। সিরিয়াল এলে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করে সে। কমলা রঙের শাড়ি পরা, মুখে মাস্ক, শাড়ির ওপরে সাদা গাউন, ডাক্তার ল্যাপটপে

কী যেন করছে। ডাক্তার বলেন, বসুন। অপূর্ব ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে। কণ্ঠ ও চোখ দুটি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছটফট করা শুরু করে! ডাক্তার তখনো অপূর্বর দিকে তাকায়নি। ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে রোগীর নাম জিজ্ঞাসা করে। কী নাম? অপূর্ব। নাম শুনেই অপূর্বর দিকে তাকায় ডাক্তার। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে অপূর্বকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। তবে সেটা প্রকাশ করেননি। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করে, কী সমস্যা? অপূর্ব বলা শুরু করে। সব শোনার পর ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে, কী করেন? এক সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। তৃষার চোখে পানি আসে। চশমা খুলে টিস্যু দিয়ে চোখ মোছে! প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিয়ে বলে, এক মাস পর আবার দেখা করবেন। অপূর্ব জিজ্ঞাসা করে, আমি ভালো হব তো? আপনি ভালো হয়ে যাবেন।
তবে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করতে হবে। অপূর্ব রুম থেকে বের হয়ে যায়।