চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শিল্পী সবিহ্ উল আলমের জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়ায় ১৯৪০ সালের ৮ নভেম্বর। বাবা ছিলেন সাবরেজিস্ট্রার কথাশিল্পী মাহ্বুব–উল আলম, মাতা রাহেলা খাতুন। বাবার চাকরির সুবাধে আলম পরিবার পটিয়ায় তালতলা চৌকি গ্রামে ভাড়া বাসায় থাকতেন। ছয় বছর সেখানে ছিল। তাঁদের আদি নিবাস হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে।
শিল্পী সবিহ্ উল আলম ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম কাজেম আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৫৯ সালে নাইট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তী সময়ে এশিয়া ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি নিয়ে লাহোর আর্ট কলেজ থেকে শিল্প ও নকশায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নিজেকে শিল্প ও নকশা পেশায় নিয়োজিত করেন। এস এমই ফাউন্ডেশনের স্পিকার হিসেবেও তিনি নিয়মিত ক্লাস নেন।
১৯৭১ সালে যে কজন শিল্পী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ছবি আঁকার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী সবিহ্ উল আলম। ছয়জন শিল্পীর ১০৪ ফুট লম্বা আঁকা ছবির নাম ছিল ‘আবহমান বাংলা ও বাঙালি’। ছবিটি এখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে রয়েছে। সে সময় পাকিস্তানবিরোধী ছবিটি বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭৩ সালে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পী সবিহ্ উল আলম ছিলেন চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর এই মানুষটি শুধু শিক্ষকতায় থেমে থাকেননি। তিনি একাধারে শিল্পী, গায়ক, মডেল, শিশু ও প্রকৃতিপ্রেমী।
বন্ধুসভা: আপনার শৈশব কেমন কেটেছে?
সবিহ্ উল আলম: শৈশবের ছয়টি বছর কেটেছে পটিয়ায়। মায়ের স্নেহসুধা, বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, মেজ আপা, সেজ আপাদের আদর—আমাকে নিয়ে সবাই কাড়াকাড়ি করতেন। বাবার চাকরির সুবাধে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমরা পটিয়ায় থাকতাম। ভাইবোন, চাচা, মা–বাবার সঙ্গে আনন্দ আড্ডায় হই হই রই রই করে কাটিয়েছি। বই পড়া, ছবি আঁকা, লেখালিখি নিয়ে কেটেছে শৈশব।
বন্ধুসভা: চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় আপনার ভূমিকার কথা বলুন।
সবিহ্ উল আলম: একদা শিল্পী জয়নুল আবেদিন চট্টগ্রামে বেড়াতে এলে আমাকে পরামর্শ দেন চট্টগ্রামে একটা আর্ট ইনস্টিটিউট করার। তাঁর এ কথা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তারপর ১৯৭৩ সালে শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। সবার আগ্রহে নিজে হলাম অধ্যক্ষ।
বন্ধুসভা: বিয়ে প্রেম করে নাকি মা–বাবার পছন্দে করেছিলেন?
সবিহ্ উল আলম: আমার স্ত্রীর নাম সেলিমা সবিহ। ১৯৬৫ সালে ৮ আগস্ট, মা–বাবার পছন্দে পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় আমাদের বিয়ে হয়।
বন্ধুসভা: আপনি একই সঙ্গে লেখক ও শিল্পী। লেখালেখি ও আঁকাআঁকি বিষয়ে কীভাবে অনুপ্রেরণা পেলেন?
সবিহ্ উল আলম: ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, পরিবারে বাবা-চাচারা কমবেশি সবাই লেখালেখি-আঁকাআঁকির সঙ্গে জড়িত। জেঠা সাংবাদিক শমস-উল আলম, বাবা কথাশিল্পী মাহ্বুব-উল আলম, চাচা কবি দিদারুল আলম এবং কবি, শিক্ষক, চিত্রী ও সংগীতশিল্পী ওহীদুল আলম। আমার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘মাননীয় কচু’, ‘রফিক আনোয়ারের সন্ধানে’, ‘পিঁপড়ে নেকলেস ও অন্যান্য গল্প’, ‘নিমিত্ত মাত্র’, ‘হিজ এক্সেলেন্সী মিস্টার ডিসেনট্রি’, ‘নুজমার গপ্পো’, ‘লেখা থেকে রেখা’, ‘পিকনিক’, ‘কারুকাজে যাদুকর’ ইত্যাদি। মূলত সেজ ভাই সাংবাদিক ও শিল্পী মঈনুল আলমকে দেখে আঁকাআঁকি করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। লেখালেখি-আঁকাআঁকি ছাড়া আমি মডেলিং, গানও করেছি। স্টার শিপ কনডেন্সড মিল্ক, পন্ডস ক্রিম, হোয়াইট প্লাস টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেলিং করি।
বন্ধুসভা: এখন প্রযুক্তির যুগ। ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট। সহজলভ্য অনলাইন নির্ভরতার কারণে আমাদের শিশু-কিশোরেরা কিছুটা বইবিমুখ হয়ে পড়ছে না? এ বিষয়ে আপনার পরার্মশ?
সবিহ্ উল আলম: বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তবে আসক্ত হতে দেওয়া যাবে না। এখন তো শিশুদের হাতে হাতে মোবাইল। সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করছে এবং অপব্যবহারও করছে অনেকে। অনেকে ইন্টারনেটে মাদকাসক্তের মতো আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে অনেকে বইবিমুখ হয়ে পড়েছে। বাবা–মায়েদের অবশ্যই শিশুদের হাতে হাতে বই দিতে হবে। পাশাপাশি আকাঁআঁকিও করে যেন আনন্দের সঙ্গে। আমার একটাই পরামর্শ—বড়দের লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে শিশুদের সামনে মোবাইল ও ইন্টারনেট কম ব্যবহার করা হয়। বড়রা যদি বই পড়ে, শিশুরাও বইমুখী হবে।
বন্ধুসভা: আপনার শৈশব-কৈশোরের তুলনায় এখনকার শৈশব-কৈশোরের গুণগত পার্থক্যকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সবিহ্ উল আলম: আমাদের শৈশব-কৈশোরকালে অভাবের শেষ ছিল না। অভাবের সংসারে চাহিদা ছিল অনেক। পাওয়া ছিল প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। গান শোনার খুব ইচ্ছা হতো। পাঁচ-ছয় বছর কষ্ট করে বাবা টাকা জমিয়ে একটা রেকর্ড-চেঞ্জার কিনেছিলেন। তাতেই আমাদের গান শোনার খিদেটা কমল। শৈশব-কৈশোরে আমরা ইচ্ছেমতো খেলাধুলা করতে পারতাম না। জাম্বুরা ছিল আমাদের খুব প্রিয়। মনের স্বাদ মিটিয়ে ফলটি খেতাম। মা খুব সুন্দর করে জাম্বুরাটা ছিলতেন। তারপর ওটার ভেতর পুরোনো কাগজ ঢুকিয়ে বাইরে সুতলি দিয়ে বেঁধে চমৎকার একটা বল বানিয়ে ফেলতেন। ব্যস, সেদিন থেকে আমরা ফুটবল খেলতাম। যদ্দিন জাম্বুরাটা থাকত।
এভাবে আমরা নানা ধরনের খেলাধুলা করতাম। যেমন ফুটবল, এক্কা-দোক্কা, চি-বুড়ি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, কুমির জলে নেমেছি, লুকোচুরি, ক্যারম বোর্ড, লুডু ইত্যাদি এবং আরও অনেক। এভাবে আমরা শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছি। ভাইবোনেরা প্রত্যেকেই লেখাপড়া, লেখালেখি, আঁকাআঁকি করতাম। একটা সময় এল যখন আমরা হাতে বানানো পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বের হলো। পত্রিকাটির নাম ‘রাঙা তুলির আঁচড়’। আমাদের আত্মীয়স্বজন ‘রাঙা তুলির আঁচড়’-এর শেষের দিকে চমৎকার মতামত লিখতেন।
বন্ধুসভা: এখনকার শিশু-কিশোরদের জন্য আমাদের অভিভাবকদের করণীয় কী?
সবিহ্ উল আলম: বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। শিশু-কিশোরদের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে বড়দের ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা প্রয়োজন। শিশুদের হাতে ওদের পছন্দ অনুযায়ী ভালো মানের শিশুতোষ বই তুলে দিতে হবে। আনন্দের সঙ্গে বই পড়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। বই পড়ার পাশাপাশি ছবি আঁকা, আগেরকার দিনের রূপকথার গল্পগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা, সংস্কৃতি চর্চা করা, গান করা—এক কথায় বই পাঠে আনন্দ থাকতে হবে। শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজের প্রশংসা করতে হবে, ওদের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। কখনো নেতিবাচক কথা বলা যাবে না। নেতিবাচক শব্দ পরিহার করতে হবে। সব সময় সত্য কথা এবং ইতিবাচক কথা বলতে হবে।
বন্ধুসভা: আপনার জীবনের সবচেয়ে আনন্দ ও দুঃখের স্মৃতি।
সবিহ্ উল আলম: প্রয়াত জীবনসঙ্গিনীকে বিয়ের আগে যেদিন প্রথম দেখতে গেলাম, এক দেখাতে বিয়ে বলা যায়। তার ছোট একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, যারা ছবি আঁকে, তাদের কেমন লাগে? এক বাক্যে বলল, ছবি আঁকতে ভালো লাগে। গানটান কেমন লাগে? গানও ভালো লাগে। আবৃত্তি কেমন লাগে? ভালো লাগে। সে খুব সাধারণ মেয়ে ছিল। খুব ভালো আবৃত্তি করল। অনুরোধ করাতে দ্বিতীয়বার আবৃত্তি করল। দুজনের মনের মিল, অবশেষে জীবনসঙ্গী হয়ে গেল। এটাই জীবনের সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি।
আর দুঃখের স্মৃতি বলতে, ২০০৮ সালের ১২ জানুয়ারি জীবনসঙ্গিনী না–ফেরার দেশে চলে গেল। আমি যাওয়ার কথা ছিল আগে, আমাকে একা ফেলে রেখে সে কেন চলে গেল না–ফেরার দেশে, আমি আজও এটা মেনে নিতে পারিনি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতি।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা