একই মানুষ, ভিন্ন ছায়া

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

সকাল আটটা। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি ক্লাস করতে। এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে কার ভালো লাগে! ঘুম থেকে উঠেই মেজাজ গরম। ওভাবেই তৈরি হয়ে গেলাম ক্লাসে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই একটা ছেলেকে দেখি, বিশেষ আকর্ষণীয় নয়, তবে রহস্যজনক মনে হয়! সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থী মিরাজ আলী। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায় সে আমাদের সঙ্গে পড়ছে। সিনিয়র হওয়ায় প্রথম দিকে তাঁকে দেখলেই সম্মান দিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতাম। ও সব সময় শেষের বেঞ্চের আগের বেঞ্চে বসে। উদ্ভট পোশাক পরে। শীতের দিন তাই জ্যাকেট পরা স্বাভাবিক; কিন্তু সে পরে লেদারের কালো জ্যাকেট, ব্যাগি প্যান্ট, গলায় রুপার চেইন আর হাতে ব্রেসলেট। আজকাল যাদের কেউ বলে কুল, কেউ বলে ছাপড়ি! তবে ওকে প্রচলিত অর্থে ছাপড়ি বলা যায় না। ওর ব্যবহার দারুণ।

মিরাজ গান গায় ভালো, কিন্তু নেশাখোর বলে ওর দুর্নামও কম নয়। ক্লাসের সবাই ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কেন জানি মনে হয় ওর মধ্যে একটা রহস্য আছে। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সে যেন একজন দার্শনিক। ওর নিজস্ব মতামত আমার বেশ লাগে। বেপরোয়া ছেলে। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার এতবার ফেল করতে খারাপ লাগে না? ব্রেন তো ভালোই, তাহলে রেজাল্ট খারাপ কেন এত?’ সে বিখ্যাত উক্তি দিয়ে বলেছিল, ‘একটা পরীক্ষার খাতা আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না রে।’

ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তেমন জোরালো না হলেও বেশ ছিল। আমিও বেপরোয়া, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত; তবে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া। ও আমায় একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই রাজনীতি কেন করিস?’ উত্তর দিয়েছিলাম, ‘কী জানি, অভিজ্ঞতা নিতে ইচ্ছা করল তাই জড়িয়ে পড়লাম!’ উত্তর শুনে ও খুব হেসেছিল। বলেছিল, ‘এটাই জীবন, অভিজ্ঞতা অর্জন করা ভালো।’ মিরাজ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী নয়। কখনো বামপন্থী, কখনো ডানপন্থী, কখনো নিরপেক্ষ।

আমার সঙ্গে মিরাজের বন্ধুত্ব কেউ ভালো চোখে দেখত না। সবাই বলত, ‘ভালো মেয়ে তুই, কেন ওই নেশাখোরটার সঙ্গে ঘুরিস?’ আমি বুঝতাম না কেন বলছে এসব। ওমর খৈয়ামের রুবাই পড়েছি, শরাবির চেয়েও বড় খারাপ হলো যারা মানুষের রক্ত চুষে খায়। শরাবি তো কী হয়েছে, কারও ক্ষতি তো করেনি! যাহোক, চলল সবকিছু এভাবে।

একদিন সকালে ক্লাসে এসেছি, সবকিছু ভিন্ন। নতুন সেমিস্টারে উঠেছি। ক্লাসে দেখলাম মিরাজ ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছে। কিন্তু আমি ভুল ক্লাসে ঢুকে পড়েছি, এটা জুনিয়রদের ক্লাস। মিরাজ এবারও পাস করেনি। তাই ও আমাদের জুনিয়র হয়ে গেছে! তবে মিরাজের বেশভুষা বেশ ভিন্ন। ও ধার্মিক হয়ে গেছে। যে ধর্ম দর্শনে ছিল বেপরোয়া, সেই মিরাজ আজ টুপি পরেছে, পাঞ্জাবি পরেছে। শুনেছি এখন নামাজ পড়ে রোজ, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে না। আমার সঙ্গেও বলে না। বেশ অবাক হলাম এই ছেলেটা এভাবে বদলে গেল কীভাবে!

এভাবেই আরেকটা সেমিস্টার চলে গেল। সবাই ওপরের সেমিস্টারে উত্তীর্ণ হলেও মিরাজ পাস করতে পারেনি। নতুন জুনিয়রদের ক্লাসে গিয়ে দেখলাম মিরাজকে আরও নতুন সাজে। টি–শার্ট, প্যান্ট পরেছে—একদম তথাকথিত ভদ্র ছেলেদের মতো। আমাকে এসে বলল, ‘কি রে কেমন আছিস?’ আমি হকচকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। ও হেসে বলল, ‘কোনো কারণ নেই, অভিজ্ঞতা নিতে ভালো লাগে, তাই এভাবে রই। জীবনে অভিজ্ঞতা অর্জন করা ভালো।’

শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়