জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের ১৮ জুন বিয়ের রাতে দৌলতপুর থেকে অভিমানে ও ক্ষোভে পালিয়ে যান কুমিল্লায় বিরজা সুন্দরী দেবীর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে অসুস্থ নজরুল অনেকটাই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তাঁর সেবা করার দায়িত্ব পরে বিরজা সুন্দরী দেবীর দেওরের মেয়ে আশালতার ওপর। তিনি ছিলেন ওই বাড়ির সবার বড়। বিরজা দেবী সব সময় তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। এ সময়ে আশালতার সঙ্গ কবির মন কাড়ে, যা ধীরে ধীরে প্রণয়ে রূপ নেয়।
সুস্থ হয়েই কবি তাঁর বন্ধুবর কাজী মোতাহারের সঙ্গে ৮ জুলাই কলকাতায় ফিরে যান। একই বছরের নভেম্বরে আশালতার টানে তিনি আবার ফিরে আসেন কুমিল্লায়। সেবার এক মাস ছিলেন। তখন কুমিল্লায় থাকাকালে নজরুল তাঁর বিখ্যাত দুটি কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙার গান’ রচনা করেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই কবিকে দেশজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এ প্রসঙ্গে নজরুল-গবেষক ড. আবুল আজাদ লেখেন, ‘দুই অসামান্য রচনা “বিদ্রোহী” ও “ভাঙার গান” নজরুল ইসলামের অন্তরের গভীর মর্মপীড়ার ফসল। কে এর প্রেরণার উৎস, নার্গিস না প্রমীলা? নজরুল ইসলামের তাবৎ সাহিত্যকর্মে এই দুই নারীর অপরিসীম প্রভাব মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যাবে, প্রেমের জগতে অন্তরের গভীর প্রাধান্য পেয়েছিল নার্গিস...পক্ষান্তরে প্রমীলাকে নিয়ে কবি জড়িয়েছেন জীবনজগতে, বাস্তবে।’
আশালতাকে কবি প্রমীলা বলে ডাকতেন। আর নার্গিস হলেন সেই সুন্দরী রমণী, যাঁর সঙ্গে ১৯২১ সালের ১৮ জুন নজরুলের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে চলে আসেন।
১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কবি তৃতীয়বারের মতো কুমিল্লায় আসেন। এই তিনবারের ভ্রমণে কুমিল্লার যুবসমাজ তাঁকে বেশ আপন করে নেয়। ১৯২২ সালের নভেম্বরে নজরুল তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতুতে সরকারবিরোধী লেখালেখির কারণে গ্রেপ্তার হন। ১৯২৩ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁর এক বছরের কারাদণ্ড হয়। এ নিয়ে দেশব্যাপী হইচই শুরু হয়ে যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এ সংবাদে ব্যথিত হয়ে তাঁর বসন্ত নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। ওই বছরই ১৫ ডিসেম্বর কবি বহরমপুর জেল থেকে ছাড়া পান এবং সেখান থেকে সোজা কুমিল্লায় গিয়ে ওঠেন।
১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল আশালতার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের দিন ধার্য হয়। অনানুষ্ঠানিকভাবে অল্প কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ পথ চলার গতি কখনো থামেনি। কবি অসুস্থ হওয়া থেকে শুরু করে আশালতা ওরফে প্রমীলা তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত কবির পাশেই ছিলেন।
আশালতার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের ব্যাপারটা বিরজা সুন্দরী দেবীও সহজে মেনে নিতে পারেননি। তাই আশালতার বিধবা মা গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ২৪ এপ্রিল কলকাতায় মেয়ের বিয়ে দেন নজরুলের সঙ্গে। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় বেনিয়াপুকুরের ৬ নম্বর হাজি লেনে সম্পূর্ণ নতুন রীতিতে। বিয়ের আগে বা পরে স্ত্রীকে নজরুল ইসলাম ধর্মে অন্তরিত করেননি। তাই যে ইসলামি প্রথা মেনে মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের বিয়ে হয়, নজরুলের ক্ষেত্রে সেই প্রচলিত রীতি পালন করা হয়নি। ‘আহলে হাদিস’ মতে, এক বৈবাহিক চুক্তি অনুসারে তাঁদের বিয়ে হয়। তাতে ধর্ম বদলের প্রয়োজন হয়নি।
বিয়ের পর নজরুল স্ত্রীর নতুন নাম দেন প্রমীলা। মেয়ের বিয়ের অনেক আগেই গিরিবালা বিধবা হন। তাঁর স্বামী বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন ত্রিপুরার রাজাদের নায়েব। তখন কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরার অন্তর্গত। নজরুলের চিঠিতেই এ তথ্য পাওয়া যায়। সংস্কৃতিসম্পন্ন স্বদেশি মনোভাবাপন্ন পরিবার ছিল তাঁদের। প্রমীলা তাঁদের একমাত্র মেয়ে। সেই মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে গিরিবালা দেবী সংস্কারের বাঁধন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন।
প্রেমিকা প্রমীলা নজরুলের কাছে রানির মতো। তিনি নিজেকে সমর্পণ করে লিখলেন,
‘হে মোর রাণি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হ’য়ে ওঠে ভারী,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।
ওগো জীবন-দেবী।
আমায় দেখে কখন তুমি ফেল্লে চোখের জল,
আজ বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তূণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।’
১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে কারামুক্ত হয়ে নজরুল আবারও ফেরেন প্রমীলার নীড়ে। তিনি এই সময়ে স্ত্রীর প্রতি নিজের মুগ্ধতা নিয়ে লিখলেন—
‘নীলাম্বরী শাড়ী পরি’ নীল যমুনায়
কে যায় কে যায় কে যায়।
যেন জলে চলে থল-কমলিনী
ভ্রমর নূপুর হ’য়ে বোলে পায় পায়।’
নজরুল-প্রমীলার বিবাহে ব্রাহ্মসমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রবাসী পত্রিকা অফিস থেকে প্রধানত নজরুল বিরোধিতার জন্য সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি প্রকাশ করা হয়। নজরুলের এই বিবাহ তাঁর মাতৃসমা বিরজা সুন্দরী দেবী অনুমোদন করেননি এবং বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত বৈকালী পত্রিকায় ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন। এ কারণে নজরুল আর কোনো দিন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে যাননি।
প্রমীলা স্বভাবতই সরল, নম্র-ভদ্র ও বিদুষী ছিলেন। সংসারের হাল ধরতে তাঁর কোনো কষ্ট হয়নি। আবার গিরিবালা দেবীও সংসারে যুক্ত হলেন। নজরুল সাত্ত্বিক জীবন যাপন করতেন। বিয়ের আগে ও পরে অনেক কবিতায় তিনি প্রমীলার রূপের বর্ণনা তুলে ধরেন। যেমন ‘প্রিয়ার রূপ’, ‘দোদুল দুল’ প্রভৃতি কবিতা। ‘দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা এভাবে তুলে ধরেন—
‘মৃণাল-হাত
নয়ান-পাত
গালের টোল,
চিবুক দোল
সকল কাজ
করায় ভুল
প্রিয়ার মোর
কোথায় তুল?
কোথায় তুল?
কোথায় তুল...’
প্রমীলা ৩০ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর কোমরের নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়। রোগ সারানোর জন্য কবি নজরুল কোনো চিকিৎসাই বাদ রাখেননি। স্ত্রীর প্রতি তাঁর কতটা দরদ ও প্রেম ছিল, এ সম্পর্কে অনেক গবেষকও অবগত নন। দেব-দেবী, ভূত-প্রেত, সাধু-সন্ন্যাসীর মন্দির, পীর-ফকির, তাবিজ-কবজ, মাবার, পানিপড়া এসব নিয়েও কবি প্রমীলাকে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।
কবি ভালোবেসেছিলেন তাঁর প্রেয়সী প্রমীলাকে। তেমনি ভালোবেসেছিলেন প্রমীলার জন্মভূমি ছায়াঢাকা পাখিডাকা তেওতা গ্রামকে। নজরুল তেওতা গ্রামকে নিয়ে ‘ছোট হিটলার’ নামে এক অনবদ্য কবিতা রচনা করেন। কবির দুই পুত্র সানি ও নিনির মুখ দিয়ে বলা হয়েছে—
‘মাগো! আমি যুদ্ধে যাবোই নিষেধ কি মা আর মানি
রাত্রিতে রোজ ঘুমের মাঝে ডাকে পোলান্ড-জার্মানি,
ভয় করি না পোলিশদেরে জার্মানির ঐ ভাঁওতাকে
কাঁপিয়ে দিতে পারি আমার মামা বাড়ি “তেওতা”কে।’
নিলয় ১৪, নতুনপাড়া, সুনামগঞ্জ