আউল-বাউল জয় বাংলার দেশের ‘ভুবন মাঝি’

‘ভুবন মাঝি’ সিনেমায় অপর্ণা ঘোষ ও পরমব্রত

এই চলচ্চিত্রের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে কান্না, আবেগ। প্রত্যেক ব্যক্তি—মানুষ থেকে গোটা একটা জাতির দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের তীব্র দহন। সেই দহনজাত অতীতের আয়নায় বর্তমানকে ফেলে দেখে যন্ত্রণা যেন আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। শুধু নিজের মাতৃভাষা, আত্মপরিচয় এবং মানচিত্রের পতাকাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পৃথিবীর বুকে ছোট্ট একটি দেশকে এতটা রক্ত দিতে হয়েছিল, যা জগৎসভায় বিরল। অস্তিত্বের সংকটে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই ক্ষুদ্র মনুষ্যবর্গের লড়াই আবার স্বাধীনতা আর মুক্তির ডাকে গোটা পৃথিবীর লড়াকু মানুষের প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাই গোটা একটা দেশ ও জাতির এবং সমগ্র বিশ্বের মুক্তির কান্ডারি। ফখরুল আরেফিন খানের রচনায়, নির্দেশনায় অসামান্য চলচ্চিত্রায়ণ ‘ভুবন মাঝি’ নামটির মধ্যেই সেই অসীমের ব্যঞ্জনাবাহী বার্তা নিয়ে আসে।

ইতিহাস অনুসারী ঘটনা কখনো আমাদের ১৯৭০ সালে নিয়ে চলে যায়। যাঁরা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি; সেই ভয়ংকর কঠিন দিনগুলোর মুখোমুখি হতে সাহায্য করে। ক্ষণে ক্ষণে আবার ২০০৪ সাল পেরিয়ে ২০১৩ সালে নিয়ে এসেও মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী দেশের নির্মম সত্যের সামনে দাঁড়াতে সাহায্য করে। দক্ষ চিত্রনাট্য ছাড়া এভাবে ক্ষণে ক্ষণে বাঁকবদলের ইতিহাস তুলে ধরা খুবই কঠিন। ফখরুল আরেফিন এই কঠিন কাজটাকেও সহজে মেলে ধরেছেন। রানা দাসগুপ্তর চিত্রগ্রহণ ইতিহাসের ভিতের ওপর যেন নতুন দলিল তৈরি করে। আবার চিত্রময় ঘটনার কোলাজকে মালা গাঁথার মতো সুন্দর সম্পাদনায় সাজিয়ে দেওয়ার কাজটিও সহজ নয়। সেই দিক থেকে সাইফুল ফারদিন এবং পার্থ সারথির কাজের প্রশংসা করতেই হয়।

২০১৩ সাল বাংলাদেশের একটি মক্তবে কোরআন-আরবি শিক্ষার পাঠদান চলছে। বড় হুজুরের কাছে এসে একজন খবর দেয়, আনন্দ পাগলা মারা গেছে। হুজুর বকুনি দিয়ে বলেন, ‘আনন্দ পাগলা বলবেন না, আপনাকে তো কতবার বারণ করেছি আনন্দ পাগলা বলতে। বলুন আনন্দ সাঁই।’ একজন মানুষকে সম্বোধন করে এই দুধরনের বলার মধ্যেই দুজন ইসলাম ধর্মের মানুষের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। একজন ইসলাম হুজুর সাঁইজিকে অমূল্য মানব রতন হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। অন্যজন গোঁড়া ইসলাম ‘পাগলা’ বলে তাঁকে তীব্র অশ্রদ্ধা এবং ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন। মূলত কুষ্টিয়ার এই আনন্দ সাঁইয়ের জীবন কর্মধারার সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ‘ভুবন মাঝি’ চলচ্চিত্র।

বৃদ্ধ আনন্দ সাঁই বা নাহির সাঁই চরিত্রে লালিম হককে অনেকটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-গৌতম ঘোষ জুটির ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রের লালন ফকির প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো মনে হচ্ছিল। তরুণ নাহির সাঁই চরিত্রে যে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আগাগোড়া গোটা চলচ্চিত্রে তারুণ্যের ফল্গুধারা বইয়ে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁকে বৃদ্ধ হিসেবে ব্যবহার না করে ভিন্ন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর ঘাত-প্রতিঘাতে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদেরও বয়স হয়। চামড়া কুঁচকে যায়, চুল–দাড়ি পেকে যায়, জীবনের বাঁকবদল ঘটে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁদের বীরত্বপূর্ণ তারুণ্যের কখনো বয়স বাড়ে না।

এবার ইতিহাস পিছিয়ে যায়, চোখ মেলে তাকাই। যেখানে দেখি, ১৯৭০ সালে সেই চরম রাজনৈতিক ডামাডোলের অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে নাহির গ্রাম থেকে চাচার বাড়ি কুষ্টিয়া শহরে যাচ্ছে। এবারে সে এখানে থেকে গ্র্যাজুয়েশনটা সম্পন্ন করবে। নাহির থিয়েটার ভালোবাসে। থিয়েটার করে। চাচার মেয়ের বন্ধু ফরিদাকে মনে মনে ভালোবাসে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ শৈল্পিক মনের এবং হৃদয়ের কানায় কানায় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একজন তরুণ এই নাহির। তবে বিবাদ, উত্তেজনা, দেশের অস্থির পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অচলাবস্থা এসব থেকে সে গা বাঁচিয়ে চলতে চায়। প্রেমিকা ফরিদা একেবারে উল্টো প্রকৃতির। সে থিয়েটারের সঙ্গে রাজনীতিকে যুক্ত করে দেখতে ভালোবাসে। তার দাদা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে বারবার জেলে যাচ্ছে। গুপ্ত কর্মশালা, প্রকাশ্য জনসভা, স্লোগান, পোস্টার—গণ–আন্দোলন এসবের পথ ছেড়ে যাচ্ছে না। ফরিদাও এসব কিছুকে পূর্ণ সমর্থন করে। নাহিরকে মুক্তির জন্য বিপ্লবে, দেশমাতৃকার মুক্তির ডাকে উদ্বুদ্ধ করে। সামনে যে নির্বাচন, এই নির্বাচনে হেরে গেলে রবি ঠাকুরের গান বন্ধ করে দেবে পাকিস্তান সরকার। ধীরে ধীরে ১৯৫২ সালে অর্জিত যে মুখের ভাষা, বুকের ভাষার ভালোবাসাটাও কেড়ে নেবে। এখন বুক ঠুকে রুখে না দাঁড়ালে, গোটা একটা জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

ভুবন মাঝি ছবির দৃশ্য

আবার ২০১৩ সালে এসে দেখি, শহুরে এক তরুণ প্রামাণ্যচিত্র পরিচালক আনন্দ সাঁইয়ের মৃত্যু নিয়ে শোকাহত, আনন্দ সাঁইয়ের ঘটনা নিয়ে উৎকণ্ঠিত। সে এই পরম জীবনের অধিকারী নির্মল আনন্দধারার সুর সাধক সাঁইজিকে নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে। ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে...’ গানটির সুন্দর চিত্রায়ণের মাধ্যমে পরিচালক পাশাপাশি ভিন্ন দুই প্রজন্মের দুটি প্রেমিক যুগলের প্রণয় দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন। একটি যুগল ১৯৭০ সালের, অন্যটি ২০১৩ সালের। মানুষের জীবনে প্রেম যে চিরকাল নিরন্তর প্রবহমান, সেই আবহমান কালের অনন্ত প্রেমের স্নিগ্ধ মুগ্ধ লাবণ্যে অবিরাম চঞ্চল রসধারায় ডুবিয়ে হৃদয় ভাসিয়ে নিয়ে যান।

কিন্তু শুধু প্রেমের সাধনায় তো আমরা বেঁচে থাকতে পারি না। প্রেমের পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। নাহির রক্তপাতে ভয় পায়, অস্ত্র ধরতে ভয় পায়, তার সংবেদনশীল মন মানুষ মারতে চায় না। কিন্তু এই ভয়ংকর মানুষেরা যে লাখ লাখ মানুষকে নির্মম নির্দয় হত্যা করে চলেছে। ইজ্জত-সম্মান লুটে নিচ্ছে। সর্বখাদক রাক্ষুসে প্রবলের বিরুদ্ধে সবল হয়ে না দাঁড়ালে যে আজ আর মুক্তি নেই। ফরিদা বলে, ‘তুমি অস্ত্র ধরছ না কেন? ইসলামিয়া কলেজে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হচ্ছে, তুমি যাচ্ছ না কেন?’ নাহির বলে, ‘তুমি আমাকে মানুষ হত্যা করতে বলো?’ একজন প্রকৃত প্রেমিক সাঁইয়ের মনের মধ্যেও যে প্রবল মতাদর্শগত ঝড় বয়ে যাচ্ছে, পরতে পরতে তা বোঝা যায়। গোটা জীবন ধরে ঘরে–বাইরে এভাবে লড়তে লড়তেই যেন একজন সাধক সাঁইয়ের জন্ম হয়।

একসময় সংগ্রাম পরিষদের হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে ছুটে বেড়াতে শুরু করে নাহির। বুকের ভেতরে দেশপ্রেম ফুলকির মতো জাগ্রত। যুদ্ধের ময়দানে আহত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শুশ্রূষাকেন্দ্রে এসে সেবা নিতে হয়। সেখানে অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় একজন মানবসেবিকা। যে বলে ওঠে, যারা এত এত মানুষকে মেরে ফেলছে, ভিটেমাটি ছাড়া ছিন্নমূল উদ্বাস্তু করে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে নাহির কি যুদ্ধে যাবে না? বুকে বিষের বাঁশি নিয়ে, মাথায় আজন্মকালের পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে নাহির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের বর্বরোচিত কালরাত, ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ নেতার উদ্যোগে স্বাধীন বাংলা মুজিবনগর সরকার গঠন—ইতিহাসের পাতার এসব ঘটনার ভিডিও চিত্র নানাভাবে চলচ্চিত্রে এসে যুক্ত হয়। নাহির একদিন বঙ্গবন্ধুর কুষ্টিয়ার জনসভায় যেতে চায়নি। কারণ, এত মানুষের ভিড়, কোলাহল নির্জনে, নিভৃতে বেড়ে ওঠা এই শিল্পী মনের ভালো লাগত না। সেই নাহির আবার এখন মেহেরপুরের অনুষ্ঠানে সঙ্গীসাথি নিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’ শুনিয়ে সমগ্র জাতির কণ্ঠে গান হতে প্রস্তুত হয়। কলকাতা আকাশবাণীতেও ডাক পায়।

২০১৩ সালে আনন্দ সাঁইয়ের মৃত্যু হয়। তাঁর জন্য জানাজা পড়া হবে কি না—এ নিয়ে মুসলমানরা দ্বিধাবিভক্ত। কারণ, আনন্দ মুসলমান ঘরে জন্ম নিলেও শরিয়ত মানত না। এক নারী চিত্র সাংবাদিক মহামানবের মৃতদেহের ছবি তুলতে এলে গোঁড়া মুসলিমরা তাকে বারণ করে। নারীদের ক্যামেরা নিয়ে ঘোরাও এই গোঁড়াদের চোখে অকল্যাণকর। তিনি স্বাধীনচেতা, অনড় ছবি তুলে যান। এ নিয়ে একসময় তর্কাতর্কি থেকে তীব্র বিবাদে দুই পক্ষের লড়াই বেধে যায়। ধর্মান্ধ মুসলিমরা ২০০৪ সালে আনন্দ সাঁইসহ অনেক বাউল ফকিরের চুল–দাড়ি কেটে দিয়েছিল। আনন্দ সাঁইয়ের মতো সাধকেরা ধর্ম জাতপাতের বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সহজিয়া পথে মানুষে মানুষে মিলনের কথা বলে এসেছেন। উগ্র ধর্মান্ধরা এসব মেনে নিতে পারে না।

আবার যে ফরিদা নাহিরকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে, দেশের জন্য লড়াই করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, সেই ফরিদাকেও রাজাকার আসলামের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে হয়। আসলাম রাজাকাররা উগ্র ধর্মের নামে যুদ্ধে নেমে কত মা-বোনের যে এভাবে ইজ্জত লুট করেছে। তীব্র লোভ–লালসার আড়ালে পাকিস্তান জিন্দাবাদের ধর্ম ছিল একটা দোহাই মাত্র। ফরিদার মুক্তিযোদ্ধা মামাতো ভাই মিজান একদিন দলবল নিয়ে রাজাকারের পথ আটকে দাঁড়ায়। পেছনে বন্দুক ধরে সঙ্গীসহ নৌকায় নিয়ে আসে। এই প্রথম নাহির প্রিয়তমা ফরিদার অপমানের জবাবে হাতে অস্ত্র ধরে। মাঝনদীতে আসলামকে গুলি করে। যদিও রাজাকার আসলাম নদীতে পড়ে গিয়ে কোনোভাবে বেঁচে যায়। ১৯৭৬ সালে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশের দালাল আইন উঠে গেলে আসলামের মতো কুখ্যাত রাজাকাররা জেল থেকে বেরিয়ে আসে। ২০১৩ সালে এসেও তারা বহাল তবিয়তে রাজনীতি আর নোংরামি চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশ স্বাধীন হয়। ফরিদাকে তন্নতন্ন করে অনেক খুঁজেও না পেয়ে নাহির ধীরে ধীরে একসময় ভিন্নধারার ত্যাগী জীবনের সাধক আনন্দ সাঁই হয়ে ওঠে। শিল্পীমাত্রই সাধক, শিল্পীমাত্রই যোদ্ধা। বাস্তবেও দুইয়ের সংমিশ্রণে নাহির আউল–বাউল লালনের মুক্তিযুদ্ধের দেশের এক সারাটা জীবনের মুক্তির কান্ডারি ভুবন মাঝি।

তবে মহাজীবনের মৃত্যু হলেও তার চেতনার মৃত্যু হয় না। ক্ষমতার প্রবল প্রতাপ, অত্যাচারেরও শেষ বলে কিছু আছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্যোগে রাজাকার আসলামদের বিরুদ্ধে লংমার্চ শুরু হয়। টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত সোহেলের প্রামাণ্যচিত্র মানুষকে জাগিয়ে দেয়, পুলিশ প্রশাসনকে সাহায্য করে। আসলাম রাজাকার গ্রেপ্তার হয়। এই লংমার্চের মতো শাহবাগের গণ–আন্দোলন আমরা দেখেছি। পৃথিবীর যে যে প্রান্তেই থাকি না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই গণ–আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছি। ফখরুল বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সিনেমা বানান আর আমি পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু জীবনে মুক্তিযুদ্ধের কবিতা লিখি। আমাদের হৃদয়ের সেতু ভালোবাসার বন্ধন গড়ে দিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ।

কলকাতার পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠলেন। আপনিও অভিনয়ের জগতে একজন চরম যোদ্ধা এবং প্রেমের মাজারে পরম সাঁই। লাল টুকটুকে অনবদ্য অপর্ণা ঘোষ যেন রবি ঠাকুরের নন্দিনী আবার প্রেম আর বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক আপন রঙে ফোটা রক্তকরবী। আপনার চেতনার রং থিয়েটার থেকে চলচ্চিত্রে বারবার বিকশিত হোক। মামুনুর রশীদ, কাজী নওশাবা আহমেদ, সুষমা সরকার, সুমিত সেন, মাজনুন মিজান, শুভাশিস ভৌমিক— প্রত্যেকেই নিজের সেরাটুকু দিয়েছেন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফকেও বাংলাদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে এখানে পাওয়া গেল। বাস্তব আর শিল্প মাধ্যম চলচ্চিত্র এভাবেও সেতু তৈরি করে।

‘আমি তোমারই নাম গাই...’ গানটির মাধ্যমে এই চলচ্চিত্র সুরের জগতের চিরকালীন সাধক আপামর বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক কালিকাপ্রসাদেরও চলচ্চিত্র হয়ে উঠল। চলচ্চিত্রটি দেখুক বা না দেখুক—গানটি একবার যারা শুনবে, মনের মধ্যে বাজতে থাকবে। ‘তুমি এসো ফসলের ডাকে বটের ঝুরির বাঁকে/ আর এসো স্বপ্নভূমি/ এই স্বপ্ন দুচোখ খুলে জেগে দেখা যায়/ যদি নয়ন তারায় বসো তুমি...’ নিজের চলচ্চিত্রে কালিকাপ্রসাদকে সংগীত পরিচালক হিসেবে বেছে নিয়ে আমাদের নয়নতারায় বসিয়ে রাখলেন। অকালে হারিয়ে না গেলে আরও কত সুরের স্রোতে চলচ্চিত্র জগৎকে যে সমৃদ্ধ করতে পারতেন।

কালিকার ‘দোহার’ দলের অন্য অনেকের সঙ্গে অমিত শূরেরও যথেষ্ট অবদান আছে দেখেছি এই চলচ্চিত্রে। হাওড়ার বালিতে আমার বাড়ির খুব কাছেই থাকেন অমিত। আমার ভাই রণীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিঠুনের দিদিকে বিয়ে করেছেন তিনি। অমিত শূর আমার ভাইকে ‘দোহার’ দলটির একেবারে শুরুর দিকের নিজেদের টাকায় বানানো গানের ভিডিও অ্যালবাম দেখতে দিয়েছিলেন বহু বছর আগে। সেই ভিডিও দেখে এবং নিয়মিত কালিকার অনেক অনুষ্ঠান দেখে মনে মনে আমিও ওদের যাত্রাপথের সঙ্গী হয়ে যাই। কালিকার মৃত্যু আমার পক্ষেও মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

পরিচালক ফখরুল আরেফিন নিজেও কুষ্টিয়া শহরের মানুষ। নিজের জন্ম মাটির গন্ধমাখা ইতিহাসের সঙ্গে শরীরে রক্ত চলাচলের মতো বয়ে যাওয়া গড়াই নদীকেও এই চলচ্চিত্রে ইতিহাস করে তুলেছেন। তাঁর এই শিল্প নদীর গতিধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দিগ্‌বিদিকে প্রবাহিত হোক।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত