ছোটবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি দুর্বলতা ছিল। যখনই বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিল সুন্দরবনে ঘুরতে যাবে, একমুহূর্তও দেরি করিনি। পাঁচজনের দল, ব্যাকপ্যাক নিয়ে রওনা হলাম প্রকৃতির রাজ্যে।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল—ট্রলারে করে নদী পেরিয়ে, গাইড নিয়ে সুন্দরবনের গভীরে ঢুকে পড়েছিলাম। বনটা নিস্তব্ধ, শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক আর দূর থেকে মাঝেমধ্যে শোনা যায় কোনো পশুর আওয়াজ। রাতটা আমরা কাটাব একটা পর্যটক রেস্ট ক্যাম্পে, সেটা ছিল জঙ্গলের অনেক ভেতরে।
গোধূলির সময়, হঠাৎ বন্ধুর মোবাইল সিগন্যাল পায়। ওর এক আত্মীয় ফোন করেছিল। কথা বলতে বলতে ও একটু দূরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ওর চিৎকার—‘রাফি, রাফি!’ আমরা দৌড়ে গেলাম, গিয়ে দেখি কেউ নেই। ওর মোবাইল পড়ে আছে, পাশে জুতার ছাপ, আর সেই নিঃসীম বন। গাইড বলল, ‘চিতা বাঘ বা শিয়াল হতে পারে। রাত হইছে, আর খুঁজতে যাওয়া ঠিক হবে না।’
আমরা বন্ধু হারানোর ভয়ে ভীত। গাইডের কথায় থামতেও পারছিলাম না। তাই দুটি দলে ভাগ হয়ে খুঁজতে বের হলাম। হাতে টর্চলাইট, গলায় দোয়া-দরুদ—জান না, তখন ওই অন্ধকার বনটা যেন মরুভূমির চেয়েও ভীতিকর লাগছিল। হঠাৎ একটা কণ্ঠ—‘বাঁচাও!’ আমরা ছুটে গেলাম শব্দের দিকে।
শব্দটা ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে আসছিল। এগিয়ে গিয়ে দেখি রাফি কাদায় অর্ধেক ডুবে আছে। হাত-পা নেড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কেউ একজন পেছন থেকে ওকে ঠেলে দিয়েছিল—এমনটাই বলল সে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, আশপাশে কারও ছায়াও নেই! এমনকি কোনো প্রাণীরও চিহ্ন নেই।
আমরা ওকে টেনে তুললাম। তখনই পেছনে একটা শব্দ—পাতা চাপার মতো। সবাই একসঙ্গে ঘুরে দেখি, একটা কালো ছায়া দূরে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা, মাথা নিচু, আর একদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই জমে গেলাম।
গাইড বলল, ‘দৌড়ান, পেছনে তাকাবেন না!’
আমরা পাগলের মতো দৌড় দিলাম ক্যাম্পের দিকে। টর্চের আলো লাফিয়ে উঠছিল গাছের ছায়ায়, আর পেছন থেকে ভেসে আসছিল সেই ছায়ার ধীরে ধীরে চলার শব্দ।
ক্যাম্পে পৌঁছে দরজা বন্ধ করে সবাই হাঁপাচ্ছিলাম। গাইড বলল, ‘এই জায়গাটায় আগে কয়েকজন হারিয়ে গিয়েছিল। যাদের এক দিন পরে অচেতন অবস্থায় জঙ্গলে পাওয়া যায়।’
রাতে কেউ ঘুমাতে পারিনি। শুধু জানালার পাশে কুয়াশার মধ্যে মাঝেমধ্যে একটা ছায়া নড়ে উঠত।
পরদিন সকালে ফিরে এলাম ট্রলার ঘাটে। আমাদের হাসিমুখ ছিল না, ছিল কেবল আতঙ্ক আর বিস্ময়। সুন্দরবন তার রহস্যের মুখোশ খুলে দেখিয়েছিল—প্রকৃতি শুধু সুন্দর নয়, ভয়ংকরও।