নীলার নীল জামা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
নীলার ঘুম ভাঙল বারান্দায় বসে থাকা কাকের ডাকে। জানালা গলে রোদ এসে তার মুখে পড়ছে।

গত রাত থেকে নীলার গায়ে খুব জ্বর। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। গা গরম। ঠোঁট দুটি ফেটে চৌচির। যেন গ্রীষ্মের ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে তার দুটি ঠোঁট। চুলগুলো বড্ড বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। শীত শীত লাগছে। তবু বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে না। সে জানালার পাশে শুয়ে আছে। জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে লেবু গাছ। সবুজ পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে সাদা সাদা ফুল। নীলা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে শায়লা বেগম বললেন, অমন করে তাকিয়ে কী দ্যাখছিস, নীলা?
‘ফুল।’
‘কিসের ফুল?’
‘লেবুগাছের সাদা ফুল।’
‘অমন করে দেখার কী আছে?’
সে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘মা দেখো, ফুলগুলো কীভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে! আমার খুব লজ্জা লাগছে।’

শায়লা বেগম নীলার গা ঘেঁষে বসলেন। গায়ে কাঁথা টেনে দিলেন। কপালে হাত দিয়ে আপন মনে বললেন, যাক বাবা, বাঁচা গেল। জ্বর অনেকটাই কমে গেছে।
‘পাখা বন্ধ করে দেব?’
‘না থাকুক। আরাম লাগছে এখন।’
‘কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?’
‘নাহ, মুখ তিতা হয়ে গেছে। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘কিছু না খেলে হবে, আপেল কেটে দিই?’
‘নাহ!’
‘আঙুর?’
‘নাহ!’
‘আতা ফল?’
‘নাহ!’
‘আতা ফল খা। তোর পছন্দের ফল। গ্রাম থেকে তোর ছোট মামি পাঠিয়েছে। খেয়ে দ্যাখ, ভালো লাগবে।’
‘বিরক্ত কোরো না তো মা। আতা ফল কোনো কালেই আমার পছন্দের ছিল না। ভেতরে মরুভূমির বালি আর বালি। তুমি আমার সামনে থেকে যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’

শায়লা বেগম উঠে যেতে লাগলেন। নীলা ফের ডাকল। শায়লা বেগম বললেন, ‘কিছু বলবি?’
‘না থাক, তুমি যাও।’
‘বল না শুনি।’
‘ঈদের আর কদিন আছে মা?’
‘চার-পাঁচ দিন।’
‘আমরা সেদিন যে নীল জামাটা দেখে এলাম না?’
‘হু।’
‘সেটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এনে দেবে?’
‘এভাবে বলছিস কেন? আমরা কি তোর পছন্দের জিনিস এনে দিই না?’
‘দাও তো। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি ঐ নীল জামাটা পরলে আমাকে সাক্ষাৎ পরি মনে হবে। হিহিহিহি।’
নীলার হাসি দেখে শায়লা বেগম বললেন, ‘তুই তো এমনিতেই পরি।’

নীলার ঘুম ভাঙল বারান্দায় বসে থাকা কাকের ডাকে। জানালা গলে রোদ এসে তার মুখে পড়ছে।  
ওপাশ ফিরে দেয়াল ঘড়িটা দেখে নিল। ১২টা বেজে ৪৩ মিনিট। গায়ে জ্বরের ছিটেফোঁটাও নেই। শুয়ে থাকতে এখন বরং খারাপ লাগছে। ওয়াশরুমে গেল। ঝর্ণা ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। চশমা আর খোলা হয়নি চোখ থেকে। হঠাৎ চোখ পড়ল ঝর্ণার ছিদ্রের দিকে। ছয় কিংবা সাতটা ছিদ্র দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। অনেকক্ষণ খেয়াল করল সে। হাত দিয়ে ধরে ধরে গুনল। সর্বমোট ৬৩টি ছিদ্র আছে। ৬৩ থেকে ৭ চলে গেলে কত থাকে? সে মনে মনে বলল, ৫৫? নাহ। ৫৬? হবে হয়তো। এখন আর তার হিসাব কষতে ইচ্ছে করছে না।

অনেক সময় নিয়ে সে গোসল করল। শরীরে সতেজতা ফিরে এসেছে। মাথা হালকা লাগছে। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। অনেকটা শুকিয়ে গেছে। এই দুদিনেই জ্বর তাকে কাবু করে ফেলেছে।

পরদিন সন্ধ্যায় গা কাঁপিয়ে জ্বর এল। সঙ্গে মাথাব্যথাও। হাত-পা ঝিমঝিম করতে লাগল। নীলার চিৎকারে নীড়ে ফেরা সন্ধ্যার পাখিরা উড়ে গিয়ে অন্য গাছের ডালে বসল। রশিদ সাহেব নীলাকে হাসপাতালে ভর্তি করাল। ভর্তি করানোর পর থেকে তার অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। স্বপন নীলার বড় ভাই। চট্টগ্রামে থাকে। অসুস্থতার কথা শুনে রাতেই ঢাকায় এল। সে হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করছিল। রশিদ সাহেবকে দেখে স্বপন দৌড়ে গেল। গিয়ে বলল, ‘বাবা, রাত পৌনে দুইটার দিকে...!’
‘কী?’
‘নীলা পানি চাইল। আমি নিয়ে এসে দেখি। হঠাৎ—’
‘নেই!’
‘নেই?’
স্বপন রশিদ সাহেবের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রশিদ সাহেব জানালার দিকে মুখ করে হু হু করে কাঁদতে থাকে।

শায়লা বেগম নীলার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নীল জামা দুহাতে উঁচু করে আর্ত অসহায় গলায় ডুকরে চেঁচিয়ে বলে ওঠল, ‘মা নীলা! তোর পছন্দের জামা নিলি না কেন, মা? তুই আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারলি!’

শিক্ষার্থী, বাইতুস সালাম এরাবিক ইউনিভার্সিটি, উত্তরা, ঢাকা