শহরের বুকে থেকে স্বপ্ন বুনেছিলাম, হেমন্তের কোনো একদিনে গাঁয়ের সবুজাভ প্রকৃতির মধ্যে লীন হব। হেমন্তেই প্রকৃতি সবচেয়ে বেশি অনুকূলে থাকে। শীত তখন আসি আসি করে উঁকি দেয়। ঠান্ডা-গরমের মাঝামাঝি সময়টা ছয় ঋতুর সবচেয়ে আনন্দঘন মনে হয়। শত অপেক্ষার পর দিনটির ছোঁয়া পেলাম। শহর থেকে উষ্ণতা সঙ্গে নিয়ে মধ্য দুপুরে বাসে উঠলাম। সূর্যটা ক্রমে পশ্চিমে এগিয়ে যেতে লাগল। সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাসও ইটপাথরের রাজ্য ফেলে সবুজের বুক চিরে সীমান্ত বাংলায় ঢুকতে শুরু করেছে। চোখের সামনেই সূর্য কুসুমবর্ণ ধারণ করেছে। তার মিষ্টি উষ্ণ ছায়া গিয়ে আছড়ে পড়ছে অন্তহীন পাহাড়ের চূড়ায়। হাওরের ওপরে তখনো কয়েকটা গাঙচিলের ওড়াউড়ি চোখে পড়ছিল। বকের দল অবশ্য ভরা পেটে উড়ে যাচ্ছে বন-জঙ্গলে। হয়তো ঘণ্টাখানেকের ভেতরে নিশাচর প্রাণীদের দখলে চলে যাবে চোখজুড়ানো সবকিছু। হাওরের ক্লান্ত বাতাসেও ঠাওর করলাম শীতের হাড়কাঁপানো গন্ধ। অনেককেই চোখে পড়ল সোয়েটার, মাফলার ও রুমালে জড়িয়ে গা বাঁচাচ্ছেন। আমি অবশ্য এসবে তৃপ্তি পাচ্ছি। শহরের একঘেয়ে আবহাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
গোধূলি চোখে পড়ল। সূর্যের সর্বশেষ মিষ্টি হাসি যেন ভর করছিল গরু ও ছাগলের শিঙের ওপর। সূর্যের কাছে বাসের গতি হার মানল। বাসযাত্রার শেষ হলো সন্ধ্যায়। সুনামগঞ্জ আবদুজ জহুর সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দক্ষিণের পাহাড়ে তাকালাম। নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুরমার স্বচ্ছ ধারা। সামনের পাহাড়কে খুব বেশি কাছে মনে হলো। ওপারে বোধ হয় এখনো রাত নামেনি। সীমান্তঘেঁষা বাজারের বাতিগুলো চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকাশের বুকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা তারকার মতোই লাগছে বাজারগুলোকে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে গেল। অপেক্ষা দীর্ঘ রাত পাড়ি দিয়ে সূর্যকে স্পর্শ করল।
কাকডাকা ভোর। শুধু যে কাক তা নয়; হাজার রকমের পাখি ও তাদের কিচিরমিচির। সব দেখে মনে হলো আমি এসেছি জেনেই তাদের এমন সুন্দর আয়োজন। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। আজকের পালা—গ্রামের মেঠো পথ, সবুজের সমারোহ ও নদীর নীরব কল্লোল। সুরমা নদীর বড় একটা অংশ সুনামগঞ্জেও আছে। পানিকে নামের মতোই স্বচ্ছ পেলাম। অথচ সিলেটের অংশটা দিন দিন বুড়িগঙ্গার মতো চিলের খাবারের জোগানে পরিণত হচ্ছে। হেমন্তের গ্রামকে দেখে ভেতরে ছন্দের তৈরি হলো। সবজি বাগানের এক অন্তহীন দৃশ্য। শিমখেতের ওপর চোখ পড়েছিল; ভারতের পাহাড় পর্যন্তই বিস্তৃত মনে হলো। প্রায় খেতের মধ্যেই কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে। কৃষকের পুরোনো ছেঁড়া কাপড় গায়ে। মাথা বানানো হয়েছে ব্যবহৃত মাটির হাঁড়ি দিয়ে। চোখ ফোটানো হয়েছে চুন দিয়ে এঁকে। এই কাকতাড়ুয়াগুলো পাখি থেকে নিয়ে মানুষ সবার দৃষ্টি কাড়ে। খেতের আল ধরে হাঁটতে গিয়ে এক কৃষককে বললাম, চাচা, কাকতাড়ুয়ার উপকারগুলো শুনতে পারি?
হাসি দিয়ে কপালে আনন্দের চিহ্ন এঁকে উত্তর দিলেন, ‘বাবা, অনেক উপকার। কাউয়া, বুলবইল্ল্যা সবজি খায়া লায়। কাকতাড়ুয়া ওইগুলো তাড়ায়। মানুষের খারাপ নজর থাইক্যাও বাঁচায়।’ আরেকটু সামনে এগিয়ে খেতের আলে দেখি পাঁচ-ছয় কেজি টকটকে লাল টমেটো পড়ে আছে। পাখি ঠুকরিয়ে এই অবস্থা করেছে। দূরে ফেলার জন্য টুকরিতে ভরতে ভরতে চাচা বললেন, ‘কালকে আরও চাইরটা কাকতাড়ুয়া আইন্ন্যা লাগাইমু!’
দরগাহ মহল্লা, সিলেট