মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্পেনের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লামিয়াল ইয়ামাল। দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে জিতে নিয়েছে টুর্নামেন্টের সেরা উদীয়মান ফুটবলারের খেতাব। সেরা খেলোয়াড় হওয়ার দৌড়েও ছিল। আরেকজন নিকো উইলিয়ামস। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনিও ইউরো ২০২৪-এর সেরা খেলোয়াড়দের অন্যতম ছিল। সেটি নিয়েই চলতি বছরের ব্যালন ডি’অর জয়ী স্পেন ও ম্যানচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার রদ্রি বলেন, ‘১৭ ও ২২ বছর বয়সে এমন পারফরম্যান্স করা অবিশ্বাস্য, বিশেষ করে যখন দেশসহ পুরো বিশ্বের চোখ আপনার দিকে! তারা যদি জানত এই বয়সে আমি কী করতাম, তারা বিস্মিত হতো।’
২৮ বছর বয়সী রদ্রি অবশ্য ভুল বলেননি। ইউরো ২০২৪-এ সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জেতার পরও তাঁকে নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে তেমন আলোচনা দেখা যায়নি। মূলত অক্টোবরে ব্যালন ডি’অর জয়ের পর তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু। যদিও সেই আলোচনা নেতিবাচক বেশি। অধিকাংশের ধারণা, এবার ব্যালন ডি’অর পাওয়ার যোগ্য দাবিদার ছিল ব্রাজিল ও রিয়াল মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। আবার কেউ বলছেন, সমর্থকদের মধ্যে রদ্রির কম গ্রহণযোগ্যতার কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর ভালো পিআর নেই। এমনকি স্প্যানিশ অধিনায়ক সোশ্যাল মিডিয়াও ব্যবহার করেন না। এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক হতে পারে।
সম্প্রতি প্লেয়ারস ট্রিবিউনে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন রদ্রি। তিনি জানান, তাঁর পৃথিবী দুটি। এক. ফুটবল; অন্যটি বাস্তবিক। রদ্রি বলেন, ‘আমার পরিবারে শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাবা সব সময় চাইতেন আমেরিকার কোনো হাইস্কুলে এক বছরের জন্য পড়াশোনা করতে যেতে; কিন্তু আমার ফুটবলের স্বপ্ন এটিতে অসম্ভব করে তোলে। ১৪ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের একটি বনে গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প করতে যাই। যখন সেখানে পৌঁছালাম, মনে হলো হলিউডের কোনো মুভি; যেখানে বড় লেকের পাশে স্কুলের বাচ্চারা ক্যাম্প করে, চারপাশে বনাঞ্চল এবং আপনি গাছে চড়ছেন, তাঁবুতে ঘুমাচ্ছেন ও ক্যাম্পফায়ার করছেন। অভিজ্ঞতা এমনই ছিল।’
‘মোবাইল নেই, ওয়াইফাই নেই। সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশে আমি একা এবং নতুন বন্ধু বানানোর চেষ্টা। সহপাঠীদের বলতাম, “হ্যালো, আমি রদ্রিগো, মাদ্রিদ থেকে। কখন আমরা ফুটবল খেলব?” (আমার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি শুনে তারা হাসত।)’ যোগ করেন তিনি।
মাঝেমধ্যে সহপাঠীরা মজা করে বলত ‘নরমাল’। আবার তাঁর বান্ধবী অথবা মাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, সে ‘নরমাল’ থেকেও অনেক দূরের জিনিস। রদ্রি বলেন, ‘যখন ফুটবলের কথা আসে, আমি পুরোপুরি আসক্ত। হয়তো আমাকে “নরমাল” বলার কারণ, আমি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি না বলে।’
মা–বাবার স্বপ্ন ছিল, ছেলে পড়াশোনা করে বড় কিছু হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তবে রদ্রির মন পড়ে থাকত ফুটবলে। আবার পড়ালেখাও ছাড়া যাবে না। তাই নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পরিবারের সঙ্গে চুক্তি হলো—খেলার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে হবে। ১৭ বছর বয়সে মাদ্রিদ থেকে ভিলারিয়ালে পাড়ি জমান তিনি এবং জাউমে আই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের পুরোটা সময় ভিলারিয়াল ফুটবল একাডেমিতে সতীর্থদের সঙ্গে থাকেন রদ্রি। বয়স ১৮ হওয়ার পর সেখানে আর থাকা সম্ভব হয়নি।
ব্যালন ডি’অর জয়ী এই ফুটবলার বলেন, ‘যখন বয়স ১৮ হবে, আপনাকে “প্রাপ্তবয়স্ক” হিসেবে গণ্য করা হয়। নিজের আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজতে হয়। তখন মা আইডিয়া দিল, কেন তুমি ইউনিভার্সিটির ডর্মে উঠছ না? তারপর আমি সেটিই করলাম। ডর্মে আমার একটি ছোট রুম হলো। সেখানে কাঠের একটি বিছানা ও একটি টেবিল। কোনো টেলিভিশন বা প্লেস্টেশন ছিল না। শুধু একটি ল্যাপটপ ছিল। সকালে ভিলারিয়ালে ট্রেনিংয়ে যেতাম, বিকেলে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতাম।’
ইউনিভার্সিটির সহপাঠীদের কাছে রদ্রি ছিল সাধারণ একজন ছেলে। যে তাঁদের সঙ্গে মিশত ঠিকই; কিন্তু পার্টিতে যেত না, বিয়ার পান করত না। এমনকি তাঁরা জানত না যে সে ফুটবল খেলে। রদ্রি বলেন, ‘আমি তাঁদের সঙ্গে থাকলেও কেবল পানি পান করতাম। তারপর সবাই যখন ক্লাবে যেত, আমি সেখান থেকে উধাও হয়ে যেতাম।’ সে সময় ভিলারিয়ালের সেকেন্ড টিমের সঙ্গে অনুশীলন করত সে।
পরের বছর লা লিগায় অভিষেক হলো। রদ্রির ভাষায়, সহপাঠী ও বন্ধুরা সেটি বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তাঁরা বলেছে, টেলিভিশনে আমার মতো একটি ছেলেকে খেলতে দেখেছে! বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে এটি আমি ছিলাম। এরপরে সবাই গুগল করে। তবু বিশ্বাস করতে চায়নি। বলেছে, ‘সে আমাদের রদ্রি হতে পারে না। এমন আরও অসংখ্য রদ্রি আছে। সেটি কোনোভাবেই আমাদের রদ্রি না।’ তারপর যখন একের পর এক ম্যাচ খেলতে লাগলাম, সবাই ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে লাগল, এটা আমি। ম্যাচ খেলে আমি আবার ইউনিভার্সিটিতে চলে আসতাম। সহপাঠীরা অবাক হয়ে বলত, ‘এই তুমি না গত রাতে বার্সেলোনায় খেলছিলে, এখানে কী করছ?’
ওই সময়গুলোকে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত উল্লেখ করে স্পেন তারকা বলেন, ‘খেলা শেষে যখন ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছাতাম, আমার মস্তিষ্ক অটোমেটিক অন্য একটি দুনিয়ায় “সুইচ” করত। দারুণ বিষয় হলো, ইউনিভার্সিটি ডর্মেই বান্ধবীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। সে মেডিকেলে পড়াশোনা করছিল। ফুটবল নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। এমনকি সে জানতে চাইত না ম্যাচের ফলাফল কী! সে সব সময় বলত, “মাটিতে পা রাখো। শান্ত থাকো। এটা কেবল ফুটবল।”
খেলা শেষ করে ইউনিভার্সিটি, আবার ইউনিভার্সিটি থেকে খেলার মাঠ—এভাবেই দিন যাচ্ছিল। রদ্রি মনে করত, সে দুটি দুনিয়া বেশ ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছে; কিন্তু ভুল ভাঙল এক ঘটনায়। রদ্রি বলেন, ‘যখন আমি ইউনিভার্সিটির রুমে থাকতাম, তখন বাকি দুনিয়া সম্পর্কে ভুলে যেতাম। একদিন কী হলো, পরীক্ষা বা এমন কিছুর জন্য পড়াশোনা করছিলাম; ফোন সাইলেন্ট মোডে দেওয়া। হঠাৎ বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেখি, ২০টি টেক্সট মেসেজ, ৫০টি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ১০টি মিসডকল। ভাবলাম, কেউ মারা গেল নাকি! মূলত সতীর্থরা কল করছিল। ফোন ধরার পর—
“রদ্রি, তুমি কোথায়?”
“আমি ইউনিভার্সিটিতে।”
“ম্যানেজার তোমাকে খুঁজছে, সবাই তোমাকে খুঁজছে।”
“তুমি কী বলতে চাচ্ছ।”
“আমরা ভ্যালেন্সিয়ায় খেলতে যাচ্ছি। সবাই এখন বাসে।”
মনে করেছিলাম তাঁরা আমার সঙ্গে মজা করছে। বললাম, “খেলা তো আগামীকাল…।”’
‘স্কুলে মাঝেমধ্যে এমন হয় যে কখনো কখনো পরীক্ষার কথা ভুলে যেতে পারেন; কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এটা স্কুল ছিলাম না। এটা লা লিগা। তাঁদের বললাম, “বাস ছেড়ে দিতে বলো। আমি সবার সঙ্গে হোটেলে মিটআপ করব।” তারপর দ্রুত ব্যাগে জামাকাপড় নিয়ে নিজের গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম। এক ঘণ্টার দূরত্ব। যখন পৌঁছাই, দেখলাম সবাই টিম মিটিংয়ে।’
এ ঘটনা তাঁকে বেশ বড় শিক্ষা দিয়েছে। রদ্রি বলেন, ‘এমনটা ফুটবলে চলে না। ওই দিনটা নষ্ট করলাম এবং আমি এটা ডিজার্ভ করি। আমার জন্য বেশ শিক্ষণীয় ছিল। এত দিন মনে হতো দুটি দুনিয়া বেশ ভালোভাবেই ম্যানেজ করছিলাম। সেই ধারণাটাও ভাঙল।’ তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের প্রতিটি ধাপ থেকে কিছু না কিছু শিখি। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিই এবং নতুন কিছু যোগ করি। ভিলারিয়ালে পেশাগত দিক কী জিনিস সেটি শিখেছি। কেবল ফুটবলার হিসেবে নয়, পেশাদার একজন মানুষ হিসেবে। তারপর আতলেতিকো মাদ্রিদে গেলাম এক মৌসুমের জন্য। ডিয়োগো সিমিওনের অধীন সেখানে শিখেছি প্রতিযোগিতামূলক মনমানসিকতা। শিখেছি কীভাবে ফুটবল মাঠে কঠোর হতে হয়। কীভাবে ট্যাকল দিতে হয়। তার পরের বছর ম্যানচেস্টার সিটিতে গেলাম। এটা আমার জন্য স্বপ্নের মতো। পেপ গার্দিওয়ালা আমার শিক্ষায় ফাইনাল ধাপটা পূরণ করেছে। বিশেষ করে খেলাকে ভিন্নভাবে দেখা, অনুভব করা। তাঁর আত্মবিশ্বাস আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
ম্যানচেস্টার সিটির এই তারকা কেমন সাধারণ জীবনযাপন করেন, তার আরও একটি উদাহরণ দিই। ২০১৯ সালে সিটিতে রদ্রির সতীর্থ ছিল সার্হিও আগুয়েরা, ডেভিড সিলভা, কেবিন ডি ব্রুইনা ও ফার্নান্দিনহোর মতো কিংবদন্তিরা। তাঁরা রদ্রিকে নিয়ে অনেক মজা করতেন। তবে পোশাকের জন্য নয়। রদ্রি বলেন, ‘প্রতিবার ম্যাচ শেষে বাসে উঠে আমি বান্ধবীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতাম। জিতি আর হারি, প্রতিটি ম্যাচ শেষেই তাঁকে কল দিতাম। যখন জিততাম, কোনো সমস্যা হতো না। কারণ, সতীর্থরা তখন উল্লাস করত; আমার ফোনে কথা বলাটা তারা খেয়াল করত না; কিন্তু যেদিন ম্যাচ হেরে যেতাম, আমি তখন সাধারণ মানুষ। কোনো ফিল্টার নেই। যখন বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতাম, আমার মস্তিস্ক ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে ফিরে যেত। আবারও রদ্রিগো বনে যেতাম। হারার পর বাসে পিনপতন নীরবতা। সবার মাথা নিচু এবং হতাশায় মোড়ানো। আর আমি কথা বলতাম জোরে। তখন আগুয়েরাসহ অন্যরা আমাকে খোঁচা দিত। বলত, “বাসে তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না। পেপ তোমাকে শুনতে পায়! সবাই তোমাকে শুনতে পায়!” তবে আমি পাত্তা দিতাম না। প্রতি ম্যাচ শেষেই বান্ধবীকে কল দিতাম। আমরা ছিলাম টিনএজারদের মতো। সবাই বিরক্ত হয়ে যেত। সতীর্থরা ফোন কেড়ে নিতে চাইত।’