শহরটার নাম কেউ জানে না। কেউ জানতেও চায় না। তবে এখানকার নিয়ম একটাই—সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখোশ পরে নিতে হয়। রঙিন মুখোশ—হাসি আঁকা, চোখে ঝকমকে দীপ্তি ও ঠোঁটে নকল উচ্ছ্বাস। কেউ কারও মুখ দেখে না। দেখে কেবল মুখোশটা।
নীরা এখানে নতুন এসেছে। প্রথম দিন অফিসে ঢুকে সে চমকে ওঠে—সবাই এক, একই হাসি, একই ঠান্ডা চোখ। কেউ কারও দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। কেবল নিয়মমাফিক জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন আছেন?’ সবাই উত্তর দেয়, ‘ভালো আছি।’
কিন্তু নীরা জানে এই মুখোশের নিচে জমে আছে না–বলা গল্প, দম আটকে আসা কান্না ও চাপা আর্তি। সে নিজেও একদিন অন্য শহর থেকে পালিয়ে এসেছে বুকভরা কান্না নিয়ে। প্রথম কয়েক দিন মুখোশ পরতে অস্বস্তি বোধ করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের ওপর একটা নকল হাসি পরিয়ে নেয়, কিন্তু চোখ দুটি আর লুকানো যায় না।
একদিন ছাদের এক কোণে বসে থাকা এক বৃদ্ধাকে দেখে তার চমক লাগে। নারীর মুখে কোনো মুখোশ নেই। মুখে সময়ের রেখা, চোখে একচিলতে শান্তি। নীরা জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি মুখোশ পরেন না?’ বৃদ্ধা হেসে বলেন, ‘অনেক দিন আগেই বুঝে গেছি, এই শহরে কাঁদা বারণ, কিন্তু ভেঙে পড়া নয়। মুখোশে সুখ মেলে না, কেবল ভুলে থাকার অভিনয় চলে। তাই আর অভিনয় করি না।’
সেদিন রাতে নীরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখোশটা খুলে ফেলে। আয়নার ভেতরে একটা ক্লান্ত মুখ, কিন্তু সততার ছায়া দেখা যায়। সে ঠিক করে, পরদিন মুখোশ পরবে না। হোক না বিচার, হোক না প্রশ্ন, সে এবার সত্যি থাকবে।
পরদিন অফিসে ঢুকে সে দেখে, তার মুখে মুখোশ নেই দেখে কেউ কেউ চমকে গেছে। কেউ তাকায়, কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়। এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা ছায়া মুখোশ খুলে ফেলে।
একদিন হয়তো এই শহর বদলে যাবে। হয়তো বদলাবে না। তবে নীরা জানে, মুখোশ খুলে ফেলার শুরুটা কেউ না কেউ তো করতেই হবে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলে উঠল, ‘হয়তো আমি এখনো ভালো নেই, কিন্তু অন্তত সত্যি আছি।’