সমালোচকেরাও এখন মানেন, ‘মেসিই সেরা’

লুসাইল স্টেডিয়ামে সমর্থকদের কাঁধে চড়ে ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন মেসিরয়টার্স

২০১৬ সালের ২৬ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ম্যাটলাইফ স্টেডিয়াম। কোপা আমেরিকার ফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও চিলি। নির্ধারিত সময় শেষে অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও গোল করতে পারেনি কোনো পক্ষ। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। প্রথম শটটি নিতে এলেন লিওনেল মেসি। পুরো স্টেডিয়ামে সুনসান নীরবতা। টেলিভিশনের পর্দায় বারবার দেখাচ্ছিল, রাজ্যের চাপ আর্জেন্টাইন অধিনায়কের মুখে। সেই চাপ আর সামাল দিতে পারেননি তিনি। গোল মিস করলেন! আরও একবার স্বপ্নভঙ্গ আর্জেন্টিনার। আকাশি-নীল রঙে ছেয়ে যাওয়া স্টেডিয়ামে আবারও নীরবতা।

এটি ছিল মেসির জন্য টানা তিনটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে পরাজয় এবং সব মিলিয়ে চতুর্থ। এর আগে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে অল্পের জন্য জার্মানির কাছে হারতে হয়েছে। ওই সময় মেসির সমালোচকেরা সব সময় বলতেন, সে ঠিক যতটা বার্সেলোনার, ততটা আর্জেন্টিনার নন। এমনকি অসংখ্য আর্জেন্টাইনও তাঁদের অধিনায়ককে পছন্দ করতেন না। সেটি তৎকালীন বার্সা তারকাও বুঝতেন। তাই তো কোপা আমেরিকা ফাইনালে চিলির কাছে পরাজয়ের মাসখানেক পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন লিওনেল মেসি। তখন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমি আর্জেন্টিনার সঙ্গে চ্যাম্পিয়ন হতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। আমি এটা সফল করতে পারিনি। আমি মনে করি, অবসর নেওয়াই আমার জন্য ভালো এবং তা আমার, যাঁরা এটা চান এবং সবার জন্যই।’

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে মেসি, দি মারিয়া, দিবালাদের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস
ছবি : ফিফা

কোপা আমেরিকার ওই ফাইনালের ঠিক ৬ বছর ৬ মাস পর আরও একটি ফাইনালে লিওনেল মেসি। এবার বিশ্বকাপ এবং প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, এটাই বিশ্বকাপে তাঁর শেষ ম্যাচ। কিন্তু নিয়তির কী লিখন! আবারও ম্যাচ গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। প্রথম শটটি নিতে এলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। তবে এবার চাপের থেকেও বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। গোল করতেও ভুল করলেন না। এর কয়েক মিনিট পর কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম থেকে মেসি নামের জয়ধ্বনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি আকাশি-নীল জার্সিধারীদের ঘরে। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি যখন ট্রফি হস্তান্তর করছিল, তখন মেসির চেহারায় ছিল পৃথিবী জয়ের আনন্দ, কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার কৃতিত্ব ছোঁয়ার উচ্ছ্বাস।

এই দুটি ঘটনার মাঝে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। অবসর ভেঙে জাতীয় দলে ফেরেন মেসি। তার আগে দেশটির সেরা ফুটবলারকে ফেরাতে সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আরজি জানায় ভক্তরা। তৎকালীন আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং নম্বর টেনকে অবসর ভাঙার অনুরোধ করেন। ১৫ বছরের বালক এনজো ফার্নান্দেজ তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘লিওনেল তুমি যা চাও সেটাই করো, তবে জাতীয় দলে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে আরও একটু চিন্তা করো। থেকে যাও এবং আনন্দ করো। নীল–সাদা জার্সিতে তোমাকে খেলতে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়। মজার জন্য খেলো। কারণ, যখন তুমি আনন্দে থাকো, তোমার কোনো ধারণাই নেই আমরা কত বেশি আনন্দে থাকি।’

বিশ্বকাপের সেরা চার ব্যক্তিগত পুরস্কারের তিনটিই হাতে তুলেছেন আর্জেন্টাইনরা। সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল লিওনেল মেসির, সেরা গোলরক্ষকের গোল্ডেন গ্লাভস এমিলিয়ানো মার্তিনেজের আর সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি এনজো ফার্নান্দেজের। সর্বোচ্চ গোল করে গোল্ডেন বুট কিলিয়ান এমবাপ্পের।
ছবি: এএফপি

কাকতালীয় ব্যাপার হলো, ১৫ বছরের সেই বালক এবার মেসির বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণের পথের অন্যতম কান্ডারি। জিতেছেন টুর্নামেন্টের সেরা নবীন খেলোয়াড়ের পুরস্কার। আর পিএসজি তারকা জিতেছেন বিশ্বকাপ সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ও হন তিনি। তবে এবারেরটা সবদিক দিয়েই এগিয়ে। আগের চারটি বিশ্বকাপে করেছিলেন মাত্র ৫ গোল। এবার এক আসরেই ৭ গোল! ৫টি ম্যাচসেরার পুরস্কার! নকআউট পর্বের প্রতিটি ম্যাচেই গোল পেয়েছেন। আগেই রেকর্ড সাতবার ব্যালন ডি’অর জয়ের অনন্য কৃতিত্ব গড়েছেন। চলতি মৌসুমে যে পারফরম্যান্স, তাতে আরও একটি ব্যালন ডি’অর জয়ের দৌড়ে তিনিই সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।

লিওনেল মেসি সর্বকালের সেরাদের একজন হয়েছেন আরও অনেক আগেই। তবে সমালোচকেরা সেটা মানতে চাইতেন না। তাঁর যে আন্তর্জাতিক কোনো শিরোপা নেই। সেটাও মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে বেশ ভালোভাবেই পূরণ করেছেন পিএসজি তারকা। ২০২১ সালে ঐতিহাসিক মারাকানায় ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জয় দিয়ে শুরু, এরপর লা ফিলাসামিয়ায় ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারানো এবং সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বজয়। সমালোচকেরাও এখন মেসির শ্রেষ্ঠত্ব মানতে বাধ্য হচ্ছেন।

অবশেষে হাতে বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটা স্ত্রী–সন্তানদের সঙ্গেও ভাগ করে নেন লিওনেল মেসি
ছবি: রয়টার্স

বয়স পঁয়ত্রিশে অন্য ফুটবলাররা যেখানে অবসর নেওয়ার কথা ভাবেন, একই বয়সে ফুটবল মাঠে মেসি যে জাদু দেখিয়েছেন, তা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব! এমনকি যাঁরা এত দিন পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে এগিয়ে রাখতেন, তাঁরাও সর্বকালের সেরা হিসেবে আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে মেনে নিয়েছেন।

ফুটবলের ইতিহাসে অসংখ্য কিংবদন্তি রয়েছেন। তবে সবার বিশ্বকাপ জয়ের সৌভাগ্য হয়নি। কারও কারও হলেও তাঁরা ঠিক সর্বকালের সেরা নন। অর্থাৎ, পেলে ও ডিয়েগো ম্যারাডোনা নিজেদের যে কাতারে নিয়ে গেছেন, সেই পর্যন্ত আর কেউ পৌঁছাতে পারেনি। কেউ কেউ বলছেন, বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে লিওনেল মেসি তাঁদেরও ছাড়িয়ে গেছেন!