একজন বাফেট

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বার্কশায়ার হাথাওয়ের সিইও এবং শীর্ষ ধনী ওয়ারেন বাফেটছবি: রয়টার্স

‘ওয়ারেন বাফেট: ফিউচার ইনভেস্টর’—নিজের বয়স যখন ছয়-সাত বছর, স্কুলের খাতায় নিজের নাম এভাবেই গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছিলেন ওয়ারেন বাফেট। সেই লোক এখন বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৮ হাজার ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৬ লাখ ৯০ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার সমান।

বাফেটের সম্পদের পরিমাণ কত, সেটি বোঝার জন্য বাংলাদেশের বাজেটের আকারটা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার মানে বাফেটের সম্পত্তি বাংলাদেশের বাজেটের চেয়ে দেড় গুণ বেশি। অন্যভাবে বললে বাফেটের সম্পদ দিয়ে দেড় বছর বাংলাদেশ চালানো সম্ভব। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। তবে শেয়ার ব্যবসা করেই বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী হয়েছেন ওয়ারেন বাফেট। ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কার ওমাহায় জন্ম নেওয়া মানুষটিকে নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। সেটি হচ্ছে তিনি বিনিয়োগকারী হিসেবে বেশি ভালো, নাকি ব্যবস্থাপক হিসেবে। বেশির ভাগই মনে করেন, বাফেট যত ভালো বিনিয়োগকারী, তার চেয়ে ভালো ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক। ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, তা ওয়ারেন বাফেটের চেয়ে ভালো কে আর জানে। বিশ্বাস হচ্ছে না! তাহলে অবিশ্বাসীদের জন্য একটি তথ্য—মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী বিল গেটস হরহামেশাই ওয়ারেন বাফেটের কাছ থেকে ব্যবসা পরিচালনার পরামর্শ নিয়ে থাকেন। কেবল বিনিয়োগ নয়, ওয়ারেন বাফেট এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনহিতৈষীদের একজন। তিনি তাঁর সম্পদের ৯৯ শতাংশই দানের ঘোষণা দিয়েছেন।

পুঁজি বাড়াতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুইংগাম, পত্রিকা ও কোকাকোলা বিক্রি করা শুরু করেন। স্থানীয় এক সেলুনে পোকার খেলার যন্ত্রও বসান।

২.
বাফেটের দাদার ছিল মুদিদোকান। বাচ্চা বয়সেই সপ্তাহে পাঁচ ডলার বেতনে দাদার দোকানে কাজ নেন। মাত্র ৬ বছর বয়সেই সেই দোকান থেকে ২৪ সেন্টে ৬ প্যাকেট কোকাকোলা কিনে একটু দূরে গিয়ে বিক্রি করে পাঁচ সেন্ট মুনাফা করেছিলেন। এরপর কিছু অর্থ জমিয়ে ১১ বছর বয়সে ৩৮ ডলার করে সিটিজ সার্ভিসের ছয়টি শেয়ার কেনেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই শেয়ারের দাম কমে ২৭ ডলার হয়ে যায়। কিন্তু তিনি অপেক্ষা করেছেন। শেয়ারের দর বেড়ে ৪০ ডলার হতেই বিক্রি করে দেন। তিনি এখনো মানেন, সেটি ছিল তাঁর ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই ওই শেয়ারের দাম বেড়ে ২০০ ডলার হয়ে যায়। সেই ঘটনা থেকে তিনি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়েছিলেন।

শেয়ার বেচাকেনার সামান্য লাভে সন্তুষ্ট ছিলেন না বাফেট। পুঁজি বাড়াতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুইংগাম, পত্রিকা ও কোকাকোলা বিক্রি করা শুরু করেন। স্থানীয় এক সেলুনে পোকার খেলার যন্ত্রও বসান। এতে কিছু আয় বাড়লে বাবা ব্যাংকে একটি হিসাব খুলে দেন। একসময় ব্যাংক থেকে নোটিশ এল যে বাফেটের নামে কিছু ডলার জমা পড়েছে। আয়কর দিতে হবে। বাফেটের বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। কম বয়সের কারণে স্থানীয় আয়কর বিভাগ ৩৫ ডলার ফেরত দেয়।

বিল গেটস, মেলিন্ডা গেটস ও ওয়ারেন বাফেট

ওয়ারেন বাফেট বর্তমানে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। ১৯৬৫ সালে ডুবতে থাকা এই প্রতিষ্ঠান কিনেছিলেন। এখন প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ৭০ হাজার ২০৯ কোটি ডলারের। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ৪৯৪ কোটি ডলার মুনাফা করেছে। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫টি। কোনো প্রতিষ্ঠানেই নাক গলান না ওয়ারেন বাফেট। তাঁর কাজ কেবল বার্ষিক সভায় যোগ দেওয়া। সব কটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা সিইও নিয়োগ দেওয়া আছে। তাঁদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন সব। ওয়ারেন বাফেটের নীতি হলো প্রতিষ্ঠানকে প্রধান নির্বাহী—ম্যানেজারের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। সুতরাং মূল কাজ হচ্ছে একজন যোগ্য সিইও বা ম্যানেজার খুঁজে বের করা।

৩.
‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখবেন না, কখনোই লোকসান করবেন না’—বিনিয়োগের প্রথম নিয়ম এটি। আর দ্বিতীয় নিয়ম হলো ‘প্রথমটিকে অনুসরণ করা’—শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্য অনুকরণীয় এমন উদাহরণ তৈরি করে ওয়ারেন বাফেট এখন জীবন্ত কিংবদন্তি। ব্যবসায়ী তারকা বলতে যা বোঝায়, তিনি আসলে তা-ই। বিনিয়োগে সফলতার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় হলেও কিছুটা অসফলতা রয়েছে তাঁর। তাঁর বড় অসফলতার একটি হার্ভার্ডে টিকতে না পারা।

একজন বিলিয়নিয়ারের জীবনযাপন জৌলুশে ভরা হবে—সচরাচর এমনটাই চোখে পড়ে। তবে আট হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়েও ১৯৫৮ সাল থেকে বাস করছেন একই বাড়িতে। ওমাহা হাউস নামের পাঁচ বেড ও আড়াই বাথরুমের বাড়িটি কিনেছিলেন সাড়ে ৩১ হাজার ডলারে।

কোকাকোলা ও আইসক্রিম খেয়ে ৮৭ বছর বয়সেও তরুণ ছিমছাম ওয়ারেন বাফেট। ফরচুন ম্যাগাজিনকে একবার তিনি জানিয়েছিলেন, ছয় বছর বয়সীদের মৃত্যুহার সবচেয়ে কম। এ তথ্য উদ্‌ঘাটনের পর তাদের খাবার তালিকা অনুসরণ করেন তিনি। দিনে ২ হাজার ৭০০ ক্যালরির মধ্যে ৪ ভাগের ১ ভাগ কোক থেকে আসে। ১২ আউন্স করে দিনে পাঁচবার যা পান করেন। কখনো নাশতায় এক বাটি আইসক্রিম খেয়ে দিন শুরু হয় তাঁর। একজন বিলিয়নিয়ারের জীবনযাপন জৌলুশে ভরা হবে—সচরাচর এমনটাই চোখে পড়ে। তবে আট হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়েও ১৯৫৮ সাল থেকে বাস করছেন একই বাড়িতে। ওমাহা হাউস নামের পাঁচ বেড ও আড়াই বাথরুমের বাড়িটি কিনেছিলেন সাড়ে ৩১ হাজার ডলারে।

শুধু বাড়ি নয়, এখনো তিনি নকিয়া ফ্লিপ ফোন ব্যবহার করছেন। সিএনএনকে মজা করে তিনি বলেছিলেন, ‘ফোনটি আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল দিয়েছিলেন। ২০-২৫ বছর কোনো কিছু ব্যবহার না করলে তা আমি ফেলে দিই কী করে।’
সফলতার জন্য কোনো বয়স লাগে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাফেট। ৫২ বছর বয়সে তাঁর সম্পদ ছিল মাত্র সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার। ৬০ বছর বয়সে তা হয় ৩৮০ কোটি ডলার। আর ৮৭ বছর পার হওয়ার পর তার সম্পদ ১১ গুণ বেড়ে গেছে। সেই বাফেট তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন সময় দিয়েছেন বিভিন্ন উপদেশ-পরামর্শ। তারই কয়েকটি সংক্ষেপে এমন—

ক. ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, যা করবেন, তা পুরো মনোযোগ দিয়ে করা উচিত। ব্যবসার রোমাঞ্চে বুঁদ হয়ে ব্যবসায়িক বুদ্ধি হারালে চলবে না। সজাগ থাকতে হবে সব সময়। তিনি আরও বলেন, ‘এমন ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন না, যা আপনার বোধগম্য নয়।’

খ. ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘প্রথমত, নিজের দক্ষতার ওপর বিনিয়োগ করুন। আপনার দক্ষতা যত বাড়বে, আপনার ব্যবসাও তত সৃজনশীল হবে।’

গ. ব্যবসার ক্ষেত্রে এই হলো ওয়ারেন বাফেটের মূলমন্ত্র, ‘এমন মানুষদের সঙ্গে সময় কাটান, যাঁরা আপনার চেয়ে দক্ষ।’

ঘ. বাফেট অবসর সময়ের ৮০ ভাগ বই পড়ার পেছনে ব্যয় করেন। বিজনেস অ্যাডভেঞ্চার্স, দ্য অ্যাসেস অব ওয়ারেন বাফেট এবং দ্য ইন্টেলিজেন্ট ইনভেস্টর—তরুণ উদ্যোক্তাদের এই বইগুলো পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাফেট। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ো। জ্ঞান হলো চক্রবৃদ্ধি সুদের মতো। যত পড়বে, তত বাড়বে।’

ঙ. ব্যবসার ক্ষেত্রে অতীত ও ভবিষ্যৎ—দুটিকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মানেন ওয়ারেন বাফেট। তিনি মনে করেন, ‘ভবিষ্যৎটা পরিষ্কার দেখতে না পারলেও ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা তো আমাদের অতীতটা স্পষ্ট দেখতে পাই। সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।’

চ. আপনি কাকে অনুসরণ করছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কার মতো হতে চান? খুব ভেবে এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক করুন। ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘আমাকে বলো তোমার চোখে “নায়ক” কে? আমি বলে দেব, তোমার ভবিষ্যৎ কী।’ তার মানে হচ্ছে আপনি কাকে আদর্শ বলে মানেন, সেটাই নির্ধারণ করবে আপনার ভবিষ্যৎ।

ছ. ক্রেডিট কার্ড বর্জন করার পরামর্শ দিয়েছেন ওয়ারেন বাফেট। তিনি বলেছেন, জীবনের শুরুতে ক্রেডিট কার্ডের টোপে পড়লে দাসত্বের মধ্যে পড়ে যাবেন। সেই দাসত্ব দিন দিন বাড়বে। তাই টাকা দিয়ে পণ্য ক্রয়ের চেষ্টা করুন। এটি আপনার জীবনকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে সহায়তা করবে।

জ. সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছেন ওয়ারেন বাফেট। তাঁর মতে, ‘সময় হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আর সেটির ব্যবস্থাপনায় আপনাকে দক্ষ হতে হবে। তাহলেই আপনাকে কেউ কখনো থামাতে পারবে না।’

তথ্যসূত্র: বিভিন্ন ওয়েবসাইট অবলম্বনে
লেখক: সাংবাদিক, প্রথম আলো।

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, সপ্তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৮ থেকে নেওয়া।