বিকেল হলেই শহরের সেরা একটি হোটেলের পেছনের টেবিলে চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে চায়ের টেবিলে আড্ডা দিতাম। তখন এসএসসি পাস করে কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছি। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাবা এক দিনের ছুটিতে বাড়িতে আসতেন। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন।
এ রকমই এক বৃহস্পতিবার বিকেলে বাবা হোটেলের ওই চায়ের টেবিলে হাজির। ‘ওঠো বাবা। চলো মার্কেটে যাব।’ আমার হাত ধরে হোটেল থেকে বের করে নওগাঁর সেরা মার্কেটে নিয়ে গেলেন। শহরের বিখ্যাত গার্মেন্টস।
‘বাবা, কী নিবা তুমি?’ আমি বাবাকে বললাম। তিনি বললেন, ‘আমার জন্য না বাবা, তোমার জন্য প্যান্ট কিনব। বগুড়ার ছেলেরা দেখলাম ব্লু জিনস পরে বেড়াচ্ছে। দেখতে দারুণ লাগে। পরলে তোমাকে ওদের চেয়ে বেশি ভালো লাগবে।’
কথাটা বলেই তিনি দোকানদারকে বললেন, ‘স্যাডল জ্যাক্স জিনস আছে? নেভি ব্লু কালারের?’
দোকানদার একটা সুন্দর প্যান্ট বের করে দিলেন। ওই সময়ের ৯৯৯ টাকা দিয়ে বাবা একটা প্যান্ট আমাকে কিনে দিলেন। ওই সময়ের সেরা ব্রান্ডের সেরা প্যান্ট হাতে পেয়ে আমি মহাখুশি।
রাস্তায় এসে একটা রিকশা ডেকে বাবা উঠলেন, আমাকেও উঠতে বললেন। কিন্তু তখন আমার অন্য একটি কাজ থাকায় বাবাকে প্যান্টের ব্যাগটা হাতে দিয়ে বললাম, ‘তুমি যাও, আমি পরে যাব।’
বাবা বললেন, ‘আরে নাহ্, চলো। প্যান্ট পরে তোমাকে কেমন লাগে আমি দেখব।’
‘নাহ্ বাবা, তুমি যাও। আমি এক ঘণ্টার মধ্যেই বাসায় আসছি।’
বাবা একটু ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে। জলদি এসো কিন্তু। প্যান্ট পরে তোমাকে কেমন লাগে, তা না দেখা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।’
রিকশা ঘুরিয়ে বাবা বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। মৃদু বাতাস বইছে তপ্ত দুপুরে। হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল আমার বুকে। মুচড়ে উঠল হৃৎপিণ্ড। হালকা বাতাসে বাবার পাঞ্জাবির ঝুলটা পেছনের দিকে উড়ছে। পাঞ্জাবির সেই উড়ন্ত অংশে লক্ষ করলাম অনেকটা ছিঁড়ে গেছে। সেখানে পরম যত্নে রিপু (সেলাই) করা। তবু বোঝা যাচ্ছে যে ওটা ছেঁড়া পাঞ্জাবি। মৃদু বাতাসে সেই ছেঁড়া রিপু করা অংশ উড়ছে। যদিও তিনি সরকারি অফিসের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরা সেই বাবার হাতে একমাত্র পুত্রসন্তানের জন্য বাজারের সেরা ‘স্যাডল জ্যাক্স’ জিনস প্যান্ট।
বাবা নেই। এই স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়।
নাটোর, বাংলাদেশ