নিশ্বাসে স্মৃতির ঘ্রাণ

কোরবানির ঈদের সময় ঘরে ঘরে চলে গোশত খাওয়ার মহোৎসবফাইল ছবি

কিছুদিন ধরে আদুরে এক ঘ্রাণ নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেবেলায়। যতই দিন গড়াচ্ছে, বয়স বাড়ছে; কমে আসছে আয়ুর সীমারেখা। এ সময়ে এসে মনে হচ্ছে, আমাদের জীবনে এমন কিছু স্মৃতি ও মুহূর্ত থাকে, যা কখনোই ভোলা যায় না। স্মৃতির রাজ্যে এদের প্রভাব এতটা প্রকট আর দীপ্য, চোখ বন্ধ করলেও উজ্জ্বল আলোর রেখা হয়ে দ্যুতি ছড়াতে থাকে।

তখনো মফস্‌সলের ঘরে ঘরে খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজের প্রচলন তেমনভাবে শুরু হয়নি। খাবার সংরক্ষণ করতে চাইলে হয় রোদে শুকিয়ে নয়তো সকাল-সন্ধ্যা চুলায় জ্বাল দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রাখা হতো। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময়টায় এটা বেশি করা হতো। তখন ঘরে ঘরে চলত গোশত খাওয়ার মহোৎসব।

কোরবানির ঈদের দিন বড় মামিকে দেখতাম, মুখ হাঁ করা বিশাল পাতিল ভরে গোশত রান্না করতেন। সেই গোশত আমরা ও দিনমান আসা মেহমানেরা কবজি ডুবিয়ে খেতাম। ঈদের পরদিন দুপুর কিংবা রাত পর্যন্ত চলত এই আহার। প্রথমবার রান্না করার পরও বাকি থাকত অঢেল গোশত। তখন সেগুলো আলাদা আলাদা পাতিলে হালকা হলুদ-লবণে জ্বাল দিয়ে রাখা হতো, যাতে নষ্ট না হয়।

গোশত খাওয়ার প্রথম পর্ব শেষে শুরু হতো রকমারি ভোজ। একদিন ভুঁড়ি তো একদিন পায়ার নেহারি, অন্যদিন মগজ ভাজি তো আরেকদিন সিনা কিংবা কলিজা ভুনা। আমাদের দিনরাত তখন হয়ে যেত গোশতময়। গোশত খেতে খেতে আমাদের সাধ মিটে যেত, কিন্তু গোশত আমাদের প্লেট ছেড়ে যেত না। বাসনকোসন থেকে শুরু করে ঘরদোর, কলপাড়—সবখানে কেবল গোশতের গন্ধ বিরাজ করত।

ভুঁড়ি, মাথা, পা, মগজ, কলিজা খাওয়া শেষে শুরু হতো হলুদ-লবণে জ্বাল দিয়ে রাখা গোশতের পালা। এবারও মনে না চাইলে তিন বেলা গোশত গিলতে হতো আমাদের। বারবার গরম করে খাওয়ার কারণে গোশতের টুকরাগুলো ভেঙে তেল-ঝোলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। তখন নানি সেই ঝোল দিয়ে বানিয়ে ফেলতেন মজাদার পিঠা।

এই পিঠার উপকরণ হিসেবে নানি নিতেন কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজকুচি, একটু বাড়তি মসলাপাতি এবং প্রয়োজনমতো আতপ চালের গুঁড়া। এসব গোশতের ঝোলের সঙ্গে মিশিয়ে বড় গোলাকৃতির খামির বানিয়ে রেখে দিতেন। রাতের রান্না শেষে মাটির চুলায় কয়লাগুলো যখন টকটকে লাল হয়ে তাপ ছড়াত, সেই চুলার ওপর লোহার কড়াই বসিয়ে তার ভেতরে পেতে দিতেন কলাপাতা। এর ওপরে শর্ষে তেল মেখে সেই খামিরটুকু চেপে চেপে বসিয়ে দিতেন। এরপর আরও কিছু কলাপাতা দিয়ে ঢেকে দিতেন সেগুলো। সবশেষে চুলা থেকে কিছু গনগনে কয়লা এনে ছড়িয়ে দিতেন কলাপাতার ওপরে। তারপর অনেকটা সময় ধরে কিংবা আগুনের তাপ বাড়া–কমার আন্দাজে সেগুলো চুলার ওপর রেখে দিতেন সারা রাত।

সকালবেলা চুলা থেকে কড়াই নামিয়ে পোড়া কলাপাতা আর কয়লাগুলো পরিষ্কার করতেই বেরিয়ে আসত কড়াইয়ের ছাঁচের মতো পিঠা। এই পিঠা গোশতের মতো টুকরা টুকরা করে কেটে পরিবেশন করা হতো। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখিয়ে থাকতাম—কখন পিঠা খাব। বিদ্যুৎ কালো নিমের মাজন দিয়ে দাঁত মেজে নানির কাছে যেতাম। নানি আমাদের হাতভরে পিঠা দিতেন। পিঠার টুকরাগুলো হাতে নিয়ে উঠানজুড়ে হেঁটে হেঁটে খেতাম আর আনন্দে হল্লা করতাম।

স্থানীয় ভাষায় এই পিঠাকে বলা হতো রুট পিঠা। এর বাইরের অংশ ছিল শক্ত, কামড় দিলে কড়কড় শব্দ করে ভেঙে যেত; আর ভেতরের অংশ মোমের মতো নরম। পিঠাগুলো যখন কামড়ে কামড়ে খেতাম, তখন চমৎকার এক বাটা মসলার ঘ্রাণ পেতাম। কিছুদিন ধরে এই ঘ্রাণই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই ছেলেবেলায়।

নানি মারা গেছেন অনেক দিন হলো। তাঁর সঙ্গে বিদায় নিয়েছে রুট পিঠাও। আমার মা কিছুটা এই পিঠা বানাতে পারতেন, কিন্তু নানির বানানো পিঠার মতো এত স্বাদ হতো না। নানির সঙ্গে সঙ্গে মা–ও চলে গেছেন অনেক দিন! এখন কোনোভাবেই আর সেই স্বাদ বা কম স্বাদের রুট পিঠা খাওয়া হয় না।

ব্লক-জি, বনশ্রী, ঢাকা