ফুটবল
ব্রাজিলিয়ান ফুটবল-সমর্থকদের উদ্দেশে খোলাচিঠি
চিঠিটি জুন-জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকা ফুটবল টুর্নামেন্টের পূর্বে দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে প্রকাশিত ব্রাজিল ফুটবল দলের অধিনায়ক দানিলোর। সমর্থকদের উদ্দেশে লেখা এই চিঠির কিছু অংশ অনুবাদ করেছেন তাহসিন আহমেদ।
চলুন, একে অপরের সঙ্গে সত্য কথা বলি—একজন খেলোয়াড়ের পক্ষ থেকে সমর্থকদের উদ্দেশে।
শুরুতেই বলব, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা যথেষ্ট ভালো করছি না। তার মানে এটা নয় যে আমরা চেষ্টাও করছি না, নিজেদের সর্বোচ্চটা দিচ্ছি না অথবা পরাজয়ে কোনো খারাপ অনুভূতি হয় না। আমাদের ভুল বুঝবেন না। কেউই জানে না যে এ পর্যন্ত আসতে আমাদের সবার কত কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্য আমরা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিই। প্রতিটি ম্যাচের পূর্বে সব সময় যেমনটা বলি, আমরা একটি গ্রুপ; যাঁদের মধ্যে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অনেক তাড়না ও গর্ববোধ রয়েছে।
একই সময়ে আমরা দেখতে ও শুনতে পাই—মানুষেরা আমাদের নিয়ে কী বলাবলি করছে। আপনারা হয়তো বলেন—‘তাঁরা (ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার) এসব পাত্তা দেয় না’, ‘তাঁরা আসলে খেলতেই চায় না’, ‘তাঁরা কেবল ধনী কিছু ছেলে, যাঁরা জার্সিকে ভালোবাসে না’ ইত্যাদি।
আমরা এর সবকিছুই শুনি। সত্যি বলতে, আমি বুঝতে পারি কেন আপনারা এসব বলছেন। সমর্থক ও আমাদের মধ্যে একধরনের দূরত্ব রয়েছে। এটা কেবল ব্রাজিলেই নয়, সব জায়গায়।
যেভাবেই হোক, হলুদ জার্সির জন্য আমরা কতটা ত্যাগ স্বীকার করি, সেটা হয়তো ঠিকভাবে দেখাতে পারিনি। তবে আমি অন্তরের অন্তস্তল থেকে এটা বলতে পারি, হলুদ জার্সি পরা প্রত্যেক খেলোয়াড় এটির ওজন অনুভব করেন। এটা ব্রাজিল, আপনাকে চাপ অনুভব করতেই হবে।
একটা ঘটনা শেয়ার করি। প্রথমবার যখন অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় ফুটবল দলে ডাক পাই, ওই সময়টা কখনোই ভুলব না। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে খেলছিলাম। তার আগের রাতে কেবল একটা জিনিসই চিন্তা করছিলাম, লকার রুমে আমার জার্সিটি কেমন দেখাবে। এটি হলুদ হবে নাকি নীল? মনে মনে চাইছিলাম, হলুদ হোক।
পরদিন সকালে লকার রুমে যাই এবং দেখতে পাই পারফেক্ট হলুদ জার্সি, সবুজ নম্বর এবং আমার নাম। সদ্যই জন্ম নেওয়া একটি শিশুর মতো আমি জার্সিটিকে ছুঁয়েছিলাম। তখনই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিজ্ঞা করে নিজেকে বলি, ‘তোমার জীবনের জন্য খেলবে। নিজের সর্বোচ্চটা দেবে। পরিবারের জন্য, বন্ধুদের জন্য, দেশের জন্য এবং যাঁরা তোমাকে এ পর্যন্ত আসতে সহায়তা করেছে, তাঁদের জন্য।’
তারপর আমি মাঠে গেলাম এবং সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম কীভাবে ফুটবলে লাথি মারতে হয়! অনেক নার্ভাস ছিলাম। একটা সহজ পাসও দিতে পারছিলাম না। জার্সির ওজন মনে হচ্ছিল ৫০ কিলো এবং খেলার সময় অতিরিক্ত ৫০ মিনিট বেশি! তারপর হলুদ কার্ড দেখলাম এবং কোচ আমাকে তুলে নিল।
কিন্তু আপনি জানেন কি—যখন মাঠ ছেড়ে যাই, আমার মন খারাপ ছিল না। এমনকি নিজের ওপরও রাগ হচ্ছিল না। কারণ, আমি পরবর্তী ধাপে যেতে পারছিলাম না। পা দুটি থেমে যাওয়ার আগপর্যন্ত আমি দৌড়েছি। ভাবছিলাম, এটাই কি ব্রাজিলের জন্য আমার সর্বশেষ ম্যাচ! আমি তো আমার সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
আমার জন্য ফুটবলে এটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যতটা পারো সর্বোচ্চটা দাও। কারণ, সামনে এমন অনেক মুহূর্ত আসবে, যখন পা দুটো কাজ করবে না। ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে বিপর্যস্ত মনে হবে, যখন আপনাকে সবাই ঘৃণা করবে এবং অনুভব করবেন—এই জার্সি পরার যোগ্যতা আপনার নেই।
এই অনুভূতি আমি ভালো করেই জানি। আমিও মানুষ। সব সময় নিজের সেরা সময়ে থাকি না।
অধিনায়ক হিসেবে আমি জানি, আমাদের দেশের কাছে জাতীয় দল কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এটা মনে করে এমনভাবে খেলতে হবে যে আমরা আবার পেশাদার ফুটবলার হওয়ার জন্য লড়াই করছি। কারণ, এটা ব্রাজিলিয়ানদের বিশেষত্ব। আমাদের ডিএনএতে আছে—লড়াই করা, সাহসী হওয়া ও হাল না ছাড়া।
চলুন, ফুটবলারদের মতো লড়াই না করে, বরং ব্রাজিলিয়ানদের মতো লড়াই করি। সবার জন্য আমার বার্তা খুবই সাধারণ, ‘আমরা এখানে ছবি তোলার জন্য আসিনি; এসেছি লড়াই করতে।’