‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ একটি মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপটের বেদনার ইতিহাস

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ পাশাপাশি তিনটি প্রতীকী শব্দ। আপাত অর্থে মিলহীন। কিন্তু ব্যাপ্তি অনেক গভীর ও প্রসারিত। যে হাঙর গোটা একটা জাতিসত্তাকে গিলে খায়, গিলে খেতে চায়। যে জাতির রয়েছে রক্ত দিয়ে লেখা একটা ইতিহাস, গভীর মর্মবেদনার একটা ভাষা। মাথার ওপর জনমদুখিনী মায়ের ছায়া আর স্নেহ–মমতামাখা প্রাণশক্তি। নারীর মতো নদী। নদীর মতো বহুমুখী শিল্প, সংস্কৃতি জারিত প্রবাহ। এই অনন্তকালের শান্ত নির্মল সুন্দর ধারাকে কেউ যদি ধ্বংস করতে চায়, ধ্বংসের নির্মম উল্লাসে মেতে ওঠে, তাদের প্রতিহত করতে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ—গ্রেনেড। এভাবে বর্ণের সঙ্গে বর্ণের, শব্দের সঙ্গে শব্দের অন্তর্নিহিত মেলবন্ধনে উঠে আসে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক এক প্রেক্ষাপট।

উপন্যাস পড়ে সত্যজিৎ রায় খুব প্রশংসা করেছিলেন। লেখককে চিঠি দিয়ে উপন্যাস অবলম্বনে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রায়িত করে উঠতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে চাষী নজরুল ইসলাম যথাযথ নান্দনিক দর্শনে উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন।

২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন লিখেছিলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক ছিলেন আবদুল হাফিজ। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রেসকোর্সে যাওয়ার সময় তিনি সেলিনা হোসেনের বাসায় উঠেছিলেন। এক মায়ের গল্প শুনিয়েছিলেন। যশোরের কালীগঞ্জের যে মা দুই মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবন্ধী ছেলেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক হাফিজ এই ঘটনা নিয়ে লেখককে লিখতে বলেন। লেখক প্রথমে ভেবেছিলেন, ছোটগল্প লিখবেন। কিন্তু এই ঘটনার অনুরণন এত গভীর যে পরে লিখে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’।

এই উপন্যাস পড়ে সত্যজিৎ রায় খুব প্রশংসা করেছিলেন। লেখককে চিঠি দিয়ে উপন্যাস অবলম্বনে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রায়িত করে উঠতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে চাষী নজরুল ইসলাম যথাযথ নান্দনিক দর্শনে উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন। ১৯৯৭ সালে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।

উপন্যাসের প্রবহমানতার মতো পুরো কাহিনিকে খুব ধীর লয় ও মন্থরগতিতে রিলের মধ্যে গুটিয়ে আনতে পেরেছেন চাষী নজরুল। সাহিত্যনির্ভর সুন্দর চলচ্চিত্র নির্মাণে সৃজনশীলতা ও দক্ষতায় তিনি অমর হয়ে থাকবেন। হলদি গাঁয়ের দুরন্ত চঞ্চল কিশোরী বুড়ি, কৈশোর থেকে দুই মুক্তিযোদ্ধার মা হয়ে ওঠা পর্যন্ত এবং গ্রামের দুই মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে নিজের প্রতিবন্ধী ছেলেকে বুক পাষাণ করে দেশের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া; এই বীরত্বগাথা, উপন্যাসের মতো চলচ্চিত্রেও চির অমলিন হয়ে থাকবে, যা আজ মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য দলিল।

বড় হয়ে ওঠা বুড়ি চরিত্রে সুচরিতা প্রতিটি দৃশ্যে নজরকাড়া অভিনয় করেছেন। চঞ্চলমতি গ্রাম্য যুবতী, বয়সে অনেক বড় বিপত্নীক গফুরের দুই সন্তান সলিম আর কলিমের পাড়াচড়ানো ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে মা হয়ে ওঠে। একসময় নিজের পেটে উথালপাতাল, নাড়ি ছেঁড়া ধন চাওয়া। গর্ভযন্ত্রণা পেরিয়ে বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেওয়া। এই জড়ভরত সন্তান নিয়ে অভাগিনীর হা-হুতাশ, গফুরের মৃত্যুর পর বৈধব্যবেশ। সুচরিতাকে এত সুন্দর মানিয়ে যায়, তিনি যে কত বড় মাপের দক্ষ শিল্পী, তা প্রমাণ করেছেন।

আসলে আমরা যারা এই সময়ে বসে চলচ্চিত্র দেখি, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’র বৈধব্যবেশে ঐশ্বর্য রায়ের রূপ বা মুখ চোখের সামনে বড় বেশি বসে থাকে। অথচ চাষী নজরুল ইসলাম কত আগে ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রে জিনাত এবং এই ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এ সুচরিতাকে এই রূপ দিতে পেরেছিলেন। কেবল বড় প্রচারের অভাবে এই রূপ বিশ্ববাঙালির দরবারে তেমন সমাদৃত হয়নি। তবে সব দিক বিচারে এসব ঐতিহাসিক দলিল যুগে যুগে গবেষণার কাজে লেগে এসেছে।

ইতিহাস–আশ্রিত উপন্যাসের কাহিনির বুননে এই যে গ্রামীণ জীবনযাপন, গরু দিয়ে ধান মাড়াই, হেঁটে হেঁটে পা দিয়ে নেড়েচেড়ে রোদে কচি ধান শুকানো, ওলানে মুখ রেখে বাছুরের দুগ্ধপান, হাঁস-মুরগি পালন, ডিম তুলে আনা, চাষি গফুরের লাঙল কাঁধে মাঠ থেকে ফেরা, গাছ কাটা গাছির মতো শরীরে জড়ানো দড়ি, মাটির উনুনে কাঠ–খর জ্বালিয়ে রান্না, ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল গুঁড়া করা, সরল বিশ্বাসী গ্রামের মানুষের বৃক্ষকে সাক্ষী করে মানত, মাজারে ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়া, গ্রাম্য বালকের পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান, কুটুমপাখির ডাক—অপরূপ এসব দৃশ্যই তো চোখে বারবার ভাসে, মনে গেঁথে যায়।

বুড়ির বন্ধু বৈষ্ণবীর চরিত্রে অরুণা বিশ্বাস, একসময় চরণদাসের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ভাবতরঙ্গে ডুবে মানবিক প্রেমের গান, ভক্তির গান গেয়ে বেড়াতেন। দেশের অস্থির যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনিও এখন একতারা বাজিয়ে অখিল বাউলের লেখা দেশের গান গেয়ে বেড়ান। ভিনদেশি পাকিস্তানি সেনারা নয়, তাঁর আখড়া ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যায়, চোখের সামনে অখিল বাউলকে গুলি করে হত্যা করে দেশের বেইমান রাজাকাররা। এই নরপিশাচেরা মনে করে, গান গেয়ে বেড়ানো বাউলেরাও দেশের শত্রু। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, গ্রামবাংলার বাউলদের ওপর এই অত্যাচারের ঘটনা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশেও বারবারই ঘটে! বাংলার আকাশে উড়ে বেড়ানো সুরেলা পাখির বক্ষে তির মেরে ওরা আনন্দ পায়।

বুড়ির মতো মায়েরা তবু একদিন আকাশটাকে মুক্ত করার, দেশটাকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে পেটের নাড়িছেঁড়া ধন ছেলে রইসকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে। চোখের সামনে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছে। প্রতিবন্ধী রইস চরিত্রে বিজয় চৌধুরীর অভিনয় কখনো ভোলা যাবে না। বুড়ি আসলে বাংলার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার মা। বুড়ির মতো মায়েদের ত্যাগের বিনিময়ে রক্তের নদী পেরিয়ে আজকের স্বাধীনতা। আজকের বাংলা ভাষার দেশ, বাংলাদেশ।

রইস প্রবাদের মতো সত্যি, কানা হলেও পদ্মলোচন। রইসের মতো মানুষদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলার মাঠে, ঘাটে, জলাশয়ে, পাঁকে, গোবরে আজও শাপলা ফোটে। সেই শাপলার চোখে চোখ রেখে প্রতিদিন সূর্য ওঠে।

সেলিনা হোসেন এমন একটি বাস্তব উপন্যাস লিখতে পেরেছিলেন এবং চাষী নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্রায়িত করতে পেরেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো আজও তাই আমাদের চোখের সামনে ভাসে। আমাদের শোকে সন্তপ্ত করে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত