আলোকবর্তিকায় নারী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘নর বহে হল, নারী বহে জল, সেই জল মাটি মিশে
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।’

কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মহান চরণ পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রগতিকে অনেকেই মেনে নিতে পারে না। বহু প্রতিবন্ধকতা, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একবিংশ শতকের মাঝামাঝি এসে নারীরা একটু এগিয়ে আসার সুযোগ পেলেও আটকে যান প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোয়।

নারী মানবজাতির এক বিরাট অংশ। বর্তমান যুগে দিকে দিকে নারীর জয়ধ্বনি ঘোষিত হচ্ছে। নারীরা দুর্দিনের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে আজ আলোকিত জগতের উদার প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছেছে। তাই মেধা ও যোগ্যতায় নারীদের পেছনে ফেলে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। উন্নত মানসিকতা ও বলিষ্ঠ জাতি গঠনে নারী ধরেছে আলোর মশাল।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে নারী এখন উজ্জ্বল নক্ষত্র। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, ফিলিপাইনের কোরাজন একুইনো, শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েকে চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা, ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ, নরওয়ের গ্রো ব্রান্টল্যান্ড, ইসরায়েলের গোল্ডামায়ার, আর্জেন্টিনার ইসাবেল পেরন, ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী প্রমুখ। বর্তমানে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত রয়েছেন নারী। শুধু এখানেই শেষ নয়, নারীরা এখন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্পিকার, বিচারপতি, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক, উকিল, জর্জ, ম্যাজিস্ট্রেট, সবিচসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত আছে। আকাশ থেকে পাতালপুরী, সর্বত্রে রয়েছে অবাধ বিচরণ। জ্ঞান–বিজ্ঞান চর্চায় নারীরা গৌরবময় কৃতিত্বের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বেগম রোকেয়া বাঙালি নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রগামী সৈনিক। বর্তমান যুগের নারীরা পুরুষের সঙ্গে ঘরে-বাইরে সমান অবদান রেখে চলেছে। শিক্ষিত নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে সংসার, চাকরি, রাজনীতিতে সমানভাবে অংশগ্রহণ করে চলেছে।

কোথায় নেই নারীর স্পর্শ? শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, বৈমানিক, সৈনিক, প্রধান নির্বাহী, শীর্ষ নির্বাহী, উচ্চপদের কর্মকর্তা থেকে কর্মচারী পদ পর্যন্ত নিয়োজিত। কৃষিক্ষেত্রেও নারীর অবদান কম নয়। পানিসেচ, চারা রোপণ, যন্ত্রে ধান মাড়ানো, তা সেদ্ধ শুকানো, কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প—সর্বক্ষেত্রে চোখ খুললেই নারীকে কর্মে নিযুক্ত থাকতে দেখা যায়।

নারী শুধু সংসারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, নিজেকে স্বাবলম্বী হতে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রয়েছে নারী উদ্যোক্তা। কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে সাহিত্যের পাতায় পাতায় রয়েছে নারীর পদাচরণে। নেতৃত্বের দিক থেকেও নারী আজ থেমে নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন আফ্রিকা, এশিয়া প্যাসিফিক, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা—এমনকি বাংলাদেশেও নারী নেতৃত্বের অবদান রয়েছে।

বিশ্বের যেসব প্রথিতযশা মহামান্য খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁদের পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখিয়েছেন এই নারী। যুদ্ধক্ষেত্রেও নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ কম নয়। নারী সংগ্রামী, যোদ্ধা। ঘরে-বাইরে, জীবনসংগ্রামে একজন লড়াকু সৈনিক।

নারী আঁধার ঘরের প্রদীপ। একটি জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে নারীসমাজ। শিক্ষিত নারীরাই জাতির বৃহত্তম স্বার্থ পূরণের অন্যতম হাতিয়ার। আদর্শ নারীর ওপর নির্ভর করে একটি দেশ ও জাতি। কেননা, আদর্শ মা মানেই আদর্শ সন্তান। আদর্শ সন্তান মানেই আদর্শ জাতি। আর আদর্শ জাতি মানেই আলোকিত বিশ্ব। নারী তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে জোনাকির আলোর মতো নিবু নিবু আলো জ্বালিয়ে আঁধার ঢেকে আলোর পথ দেখান। তাঁরা মহাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো। তাই নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করে নয়; বরং যথাযোগ্য সম্মান, মূল্যায়ন ও ভালোবাসা দিলে নারী হয়ে উঠবে আলোর দ্যুতির মহাবিশ্বের এক আলোকবর্তিকা।

আড়পাড়া, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ