প্রবাসের পয়লা বৈশাখ ও আমার শৈশব

বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল বাঙালিরা মহা ধুমধামে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে থাকেছবি: আশরাফুল আলম
সবাইকে পয়লা বৈশাখের শুভেচ্ছা। বছরের প্রতিটি দিন বাঙালির হোক।

দেখতে দেখতে আরও একটি বৈশাখ চলে এল। সর্বশেষ পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন করেছিলাম ২০১৯ সালে। বিগত পাঁচ বছরে কোভিড মহামারি ও দুবার দেশান্তর হওয়ায় দেশের মাটিতে পয়লা বৈশাখ আর পালন করা হলো না। এখনো আমার এক কামরার একটি ছোট্ট স্টাডি ডেস্কে নড়বড়ে ল্যাপটপটা নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, চারপাশ নীরব, শান্ত। এখানে শনি ও রোববার বন্ধ হওয়ায় মানুষের যাতায়াত খুব একটা নেই। পরিবারের মানুষ, প্রিয়জন সবাই যে যার মতো পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে ব্যস্ত। আর আমি একা মানুষ নীরবে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছি।

আমাদের ছোট্ট পরিবারে তখন জমিয়ে সেই খই, নাড়ু, লাবণ, পায়েস, পিঠা, পাঁচন, পান্তাভাত, আলুভর্তার আয়োজন হতো। সঙ্গে গরমের লেবু কাঁজি আর কালেভদ্রে ইলিশ মাছ; যদি আর্থিক সামর্থ্যে কুলাত। নইলে ডিমভাজি বা পুকুরের কোনো মাছ দিয়ে কী দারুণ বৈশাখ কাটাতাম!

সময়ের চাকা বদলেছে, ব্যস্ততা বেড়েছে, বয়সের তারতম্য হয়েছে। কিন্তু স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন সন্ধ্যা হতে পুরো ঘর বিজু ফুল আর নিমপাতা, সঙ্গে ভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে মালা গেঁথে পুরো ঘর সাজানো হতো। শুধু ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা-এই বছরটা যেন ভালো যায়। অর্থবিত্তে, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবারের সবাই যেন রক্ষা পায়। এখনো বাবা প্রতিবছর নিয়ম করে ফুল দিয়ে ঘরের প্রতিটি দরজা, বুকশেলফ, চালের ড্রাম, এমনকি রান্নাঘরটাও সাজিয়ে দেন। শুধু এই সময়ে আমি নেই গত পাঁচ বছর ধরে বাবার সঙ্গে। পয়লা বৈশাখের দিন সবাই দল বেঁধে প্রার্থনালয়ে যাওয়া, তারপর বৈশাখী প্রোগ্রামে উপস্থিত হওয়া-সবই এখন অতীত।

এখানের পয়লা বৈশাখ অন্য সব দিনের মতোই স্বাভাবিক। শুধু ভালো লেগেছে, যে ইউনিলজে থাকি; এখানে ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ যে একটা বিশেষ দিন, সেটা তাদের দিনলিপির পাতায় রঙিন করে দেওয়া হয়েছে। বাঙালি হিসেবে এটার জন্য গর্ব অনুভব করছি। এখন আমার একার পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের অনেক সামর্থ্য, কিন্তু কেন যেন সেই ইচ্ছেটা আর নেই। সবটাই ফ্যাকাশে লাগে। পরিবার ছাড়া, মা-বাবা ছাড়া, প্রিয় মানুষ ছাড়া এই পয়লা বৈশাখ ও অন্য আর দশটা দিনের মতোই। একেই হয়তো বড় হয়ে যাওয়া বলে। মাঝে মাঝে ভাবি, আর কখনো পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন করা হবে কি? নাকি আমার স্মৃতির পাতায়ই রয়ে যাবে শৈশবের পয়লা বৈশাখ!

সবাইকে পয়লা বৈশাখের শুভেচ্ছা। বছরের প্রতিটি দিন বাঙালির হোক।

পিএইচডি গবেষক, চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি, ডারউইন, অস্ট্রেলিয়া