জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই রোদ এসে পড়ে মায়াবীর ওপর। ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখতে পরির মতো লাগছে। মায়ের মুখের হাসিটা হঠাৎ মলিন হয়ে যায়। মায়াবী জন্মান্ধ, কখনো আলো দেখেনি। তার কাছে উৎসবের মানে হলো গন্ধ ও সুর। আজ মায়াবীর প্রিয় উৎসব পহেলা বৈশাখ। মা যখন আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, তখন মায়াবী জেগে ওঠে।
‘সকাল কখন হলো মা?’
‘বেশ কিছুক্ষণ।’
‘আমাকে আরও আগে কেন জাগাওনি মা? তুমি কি জানো সকালের বাতাস আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ আমার ত্ত ভালো লাগে।’
একরাশ অভিমান নিয়ে অন্যদিকে মুখ করে আছে মায়াবী। মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে মা বলেন,
‘ঝটপট তৈরি হয়ে নে, আমরা মেলায় যাব।’
প্রতি বৈশাখে মা আর মেয়ে একই রঙের শাড়ি আর ফুলের ডালা মাথায় পরে। ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আর মায়ের হাতের লাল চুড়ির টুংটুং শব্দ ছিল মায়াবীর পথ চেনার একমাত্র সঙ্গী। মায়ের লাল চুড়ির শব্দের সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না তার কাছে।
মায়াবীর বয়স যখন ১২ বছর, হঠাৎ স্ট্রোক করে মা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এরপর বৈশাখ এলেও মায়াবী সেই চিরচেনা চুড়ির শব্দ পায় না। বৈশাখে চারদিক আনন্দে মেতে ওঠে, শুধু মায়াবীর মনে নেমে আসে নীরবতা। কেটে যায় কয়েকটি বছর।
একদিন বৈশাখের বিকেলে উদাস দৃষ্টিতে জানালার পাশে বসে আছে মায়াবী। হঠাৎ তার কানে আসে চিরচেনা সেই চুড়ির টুংটুং শব্দ। মায়াবী চমকে ওঠে।
‘কে?’
‘আমি, সোমা। একটু হাত বাড়াও।’
মায়াবী হাতে পায় ঠান্ডা কাচের স্পর্শ। এক জোড়া লাল কাচের চুড়ি।
‘এটা… কোথা থেকে?’ মায়াবীর কণ্ঠে বিস্ময় ও আবেগ।
সোমা হাসে।
‘তোমার বাবা নিয়ে এসেছেন, তোমার মায়ের পুরোনো বাক্সে ছিল। তুমি কিছুদিন আগে বলেছিলে, মনে আছে?’
মায়াবী কাঁপা কাঁপা হাতে চুড়িগুলো পরে। নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোঁকে, এই তো মায়ের গন্ধ, মনে হয়, মায়ের হাতটা যেন তার হাত ধরে আছে, মায়াবীর চোখ ভিজে ওঠে।
মায়াবীর কানে ভেসে আসে গানের সুর—
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’
আর সে মনে মনে বলে, ‘তুমি এসেছ, মা! আমি স্পর্শ পাচ্ছি তোমার, এই লাল চুড়ির মধ্য দিয়ে।’
মায়াবীর চোখের জল চুড়িগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে, আর মৃদু টুংটুং শব্দ ভাসছে বাতাসে।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা