‘বই মানুষকে অনুভূতিসম্পন্ন করে, দীপিত-উজ্জীবিত করে। পালন করে মহান শিক্ষকের ভূমিকা। অতীত ও অনাগতকালের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শামসুর রাহমান, মানিক বন্দোপাধ্যায় থেকে সৈয়দ হক—সবাই বই পড়েছেন। পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে একজন লেখকের চিন্তা ও মননের জগৎ প্রসারিত হয়, রঙিন হয় তাঁর স্বপ্নগুলো। যাঁরা লেখক হতে চান কিংবা লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, তাঁদের অবশ্যই বই পড়তে হবে। বই না পড়ে লেখক হওয়া যায় না। ভালো-মন্দের বিচার করতে, শুভ-অশুভের তফাৎ বুঝতে, অনুভূতিগুলো সতেজ-সজীব রাখতেও বই পড়া জরুরি,’ বলছিলেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। প্রথম আলো বন্ধুসভার লেখক বন্ধু উৎসবে লেখালেখির নানা দিক নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখক হতে ত্যাগস্বীকার করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে লেগে থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক—সবাই লেখালেখির জন্য ত্যাগস্বীকার করেছেন, লেগে থেকেছেন।’
২ জুন সকাল ১০টায় প্রথম আলো কার্যালয়ে প্রথমবারের মতো বসেছিল নবীন লেখক বন্ধুদের মিলনমেলা। বন্ধুসভা আয়োজিত দিনব্যাপী প্রাণের এই মিলনমেলায় মিলিত হন সারা দেশের নির্বাচিত ৪৪ তরুণ লেখক বন্ধুসহ ৮০ বন্ধু। আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে আমিও এই উৎসবে অংশগ্রহণ করি। জ্যৈষ্ঠের অস্বস্তিকর গরম, দীর্ঘ পথভ্রমণের ঝক্কি উপেক্ষা করে উৎসবে অংশ নিতে মেহেরপুর থেকে যখন ঢাকায় পৌঁছাই, তখন পুবের আকাশে সূয্যি মামা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বাস থেকে গাবতলীতে যখন নামছি, তখনো ভোরের রেশ কাটেনি, অথচ বাতাসটুকু শীতল নয়। প্রচণ্ড তাপদাহ ভীষণ মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে মহানগরের গলিতে, বাসস্ট্যান্ডে, ফুটপাতে। তখনো আমার দুচোখে ঘুমের ঘোর, শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে সম্মেলনকক্ষে ঢুকেই কেটে গেল ঘুমের ঘোর, মুছে গেল শরীরময় লেপটে থাকা ক্লান্তির ছাপ। নবীন লেখক বন্ধুদের হাস্যোচ্ছ্বাসে সংবিৎ ফিরে পেলাম।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। উৎসবের প্রথম অধিবেশনে কবিতা, কবিতার ছন্দ ও প্রকরণ নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও লেখক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, ছন্দবদ্ধ হোক আর গদ্যকবিতা হোক, সব কবিতার মধ্যেই ছন্দ লুকিয়ে থাকে। অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত কবিতার ছন্দ কেমন হয়, তা মনে করিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ ও শামসুর রাহমানের কবিতার উদাহরণের মাধ্যমে।
এমন উৎসব বছরে অন্তত দুটি হওয়া উচিত। উৎসব শেষ করে ফিরতি বাসে বসেই প্রতিজ্ঞা করলাম, যত দিন বেঁচে আছি, তত দিনই লিখব। যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্তের জন্য নয়, লেখার জন্যই লিখব। স্বীকৃতি-সম্মাননা পেলেও লিখব, না পেলেও লিখব।
গল্পের কলকবজা, নাড়িনক্ষত্র, শিরোনাম লেখার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও লেখক শাহনাজ মুন্নী। তিনি বলেন, গল্প নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভাঙাগড়া চলছে সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও। কল্পনা ও অভিজ্ঞতার মিশেলে নির্মিত হয় গল্প। গল্পের সব ঘটনা যে সত্য হবে, এমন নয়। এ প্রসঙ্গে জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
ফিচার লেখার কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক আলতাফ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ হলেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ফিচারলেখক। তাঁর “পোস্ট মাস্টার” ও “এক রাত্রি” গল্প দুটিও একধরনের ফিচার। ফিচারের ভাষা জটিল তত্ত্বে ভারাক্রান্ত হওয়ার দরকার নেই, সহজ–সরলভাবে লিখতে হয়। কবিতার উদ্ধৃতিও দেওয়া যেতে পারে। ফিচার লিখতে গিয়ে কীভাবে শুরু করতে হয়, কীভাবে সমাপ্তি টানতে হয়, এ নিয়ে আমার মতো অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।’
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত লেখক বন্ধুদের আলাপ, আড্ডা এবং আলোচকদের স্নেহসান্নিধ্য, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, সম্মাননা স্মারক প্রদান, বই প্রদর্শনী সব মিলিয়ে উৎসবটি ছিল দারুণ উপভোগ্য। বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিকের উপস্থাপনা ছিল মনোমুগ্ধকর, সভাপতি উত্তম রায় অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবৎসল। নির্বাহী মৌসুমী মৌসহ জাতীয় পর্ষদের সদস্যরা বন্ধুসভার ওয়েবসাইটে লেখা পাঠাতে তাগিদ দেন ও অনুপ্রাণিত করেন। দারুণ প্রাণবন্ত ও মিশুক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। আলোচনার ফাঁকে তাঁকে জানাই, ‘আমার স্ত্রী ও কন্যা দূর্বা আপনার লেখা “মা” পড়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। আমি আপনার লেখা প্রায় প্রতিদিনই পড়ি। গতকাল পড়লাম “আলো-আঁধারের যাত্রী।”’ তিনি বললেন, ‘আপনি কী করেন, কোথায় থাকেন? লেখালেখিতে লেগে থাকুন।’
আলতাফ শাহনেওয়াজ দারুণ সপ্রতিভ ও রসবোধসম্পন্ন মানুষ। তা অবশ্য আগেই বুঝেছি প্রথম আলো ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত ‘গোপাল ভাঁড় বাস্তবের, না কল্পনার’ জনসংস্কৃতিবিষয়ক লেখাটি পড়ে। লেখাটি তৈরি করতে কৃষ্ণনগরসহ নদীয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে তিনি সফর করেছেন, ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন বিস্তর বইপত্র, নথি ও দলিল-দস্তাবেজ, তা একান্ত আলাপে আমাকে জানালেন। মোহিত কামাল, সাজ্জাদ শরিফ, আলতাফ শাহনেওয়াজরা কেবল বড় মাপের লেখক নন, বড় মাপের মানুষও বটে। তাঁদের ভাবনা ও কথামালায় অনেকখানি অনুপ্রাণিত হয়েছি। মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা লেখকসত্তাটি আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে চাইছে। কেন জানি না, লেখার প্রতি আবারও ঝোঁক বাড়ছে। এখানে এসেই জানলাম, দৈবপ্রদত্ত প্রতিভা দিয়ে লেখালেখির কৌশল আয়ত্ত করা যায় না। শ্রম, অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। উৎসবে না এলে লেখালেখিসম্পর্কিত অনালোচিত বা স্বল্পালোচিত বিষয়গুলো আমার কাছে অজানাই থেকে যেত। উৎসবে বই প্রদর্শনীতে রাখা আমার লেখা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালির সম্প্রীতি সাধনা’ বইটি সংগ্রহ করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। সপ্রতিভ ও গল্পবাজ মানুষটির এই আচরণে অভিভূত হয়েছি। আনন্দে তাঁকে অটোগ্রাফও দিয়েছি। এমন উৎসব বছরে অন্তত দুটি হওয়া উচিত। উৎসব শেষ করে ফিরতি বাসে বসেই প্রতিজ্ঞা করলাম, যত দিন বেঁচে আছি, তত দিনই লিখব। যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্তের জন্য নয়, লেখার জন্যই লিখব। স্বীকৃতি-সম্মাননা পেলেও লিখব, না পেলেও লিখব।
সভাপতি, মেহেরপুর বন্ধুসভা ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ