মহেশ্বরী,
সকাল হতে আর কিছুক্ষণ বাকি। মসজিদে ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সুরেলা কণ্ঠে ইমাম সাহেব ডাকছেন ‘…হাইয়া আলাস সালাহ...’। বাসার পাহারাদার কাকু একটু পরপর ফুঁকে যাচ্ছেন গলায় ঝুলে থাকা বাঁশি। এতক্ষণে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ছোট্ট ক্ষণজন্মা শিশুটির ঘুম ভাঙিয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। আর আমার ঘুম কে ভাঙিয়েছে জানো?
তোমার চিঠি। তোমাকে চিঠি লিখব বলে অনেক আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। এখন চিলেকোঠায় বসে নভেম্বরের হিমশীতল হাওয়া গায়ে মাখিয়ে তোমাকে লিখতে বসেছি। ভীষণ ভালো লাগছে। সাতসকালে তোমাকে চিঠি লেখার অভ্যাস আমার আজও রয়ে গেছে।
মহেশ্বরী, তোমার মনে পড়ে, আমি প্রত্যহ ভোরে তোমাকে চিঠি লিখতাম? দিনের প্রারম্ভেই ঘুম ঘুম চোখে আমার চিঠি পেয়ে তোমার সেকি আনন্দ!
আহ্ চিঠি! কত কথা, কত অভিযোগ, অভিমান আর অনুরোধের লেপন। এখনো অভিমান মিশিয়ে লেখা হয়, কিন্তু তোমার ঠিকানায় পৌঁছায় না। পৌঁছাবে কি আদৌ?
মহেশ্বরী, আজকাল খুব বাউন্ডুলে হতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে কোনো কারণ ছাড়াই হলুদ পাঞ্জাবি পরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াই। পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি।
জানো, আজকাল আমাকে মানুষ হিমু ডাকতে শুরু করেছে। হা হা হা! আমি কীভাবে হিমু হলাম? হিমুরা কখনো কারও মায়ায় নিজেকে জড়ায় না। মায়ায় না পড়তে একবার হিমুর বাবা হিমুকে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটা এ রকম-
‘প্রিয় পুত্র,
মানুষ মায়াবদ্ধ জীব। মায়ায় আবদ্ধ হওয়াই তাহার নিয়তি। তোমাকে আমি মায়ামুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়া বড় করিয়াছি। তারপরেও আমার ভয়—একদিন ভয়ংকর কোনো মায়ায় তোমার সমস্ত বোধ, সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হইবে। মায়া কূপবিশেষ, সে কূপের গভীরতা মায়ায় যে আবদ্ধ হইবে, তাহার মনের গভীরতার ওপর নির্ভরশীল। আমি তোমার মনের গভীরতা সম্পর্কে জানি, কাজেই ভয় পাইতেছি, কখন না তুমি মায়া নামক অর্থহীন কূপে আটকা পড়িয়া যাও। যখনই এইরূপ কোনো সম্ভাবনা দেখিবে তখনই মুক্তির জন্য চেষ্টা করিবে। মায়া নামক রঙিন কূপে পড়িয়া জীবন কাটানোর জন্য তোমার জন্ম হয় নাই। তুমি আমার সমগ্র জীবনের সাধনাকে নষ্ট করিও না।’
জাগতিক মায়া হুমায়ূন আহমেদের গল্পের হিমুকে স্পর্শ করতে না পারলেও তোমার মায়া আমার পিছু ছাড়ছে না। প্রতিনিয়ত নতুন করে তোমার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি। মহাপুরুষদের মায়ায় জড়াতে নেই, কিন্তু আমি পারছি না। কবিতার খাতা থেকে শুরু করে গল্পের পাতা, পড়ার টেবিল কিংবা বইয়ের তাক; সবটা জুড়েই তোমার অনিবার্য অস্তিত্ব চরমভাবে দৃশ্যমান। তোমাকে গায়ের জোরে সরাতে পারি, এমন শক্তি আমার নেই। এবার তুমি বলো, আমি হিমু হয়ে উঠতে পারলাম কই!
কেন তোমাকে চিঠি লিখি? এই প্রশ্নের উত্তরে একদিন তোমাকে বলেছিলাম, ‘আমরা যতই আধুনিক হই, আধুনিকতায় ডুবে থাকি; আমাদের হৃদয় ঠিকই পড়ে আছে নব্বই দশকে। কুঁড়েঘর, মাটির হাঁড়ি আর চিঠির খামে।’ অনেক দিন পর এই কথার যথার্থতা খুঁজে পেলাম। দুই দিন ধরে দেখছি ফেসবুকজুড়ে প্রিয়জনদের চিঠির ছড়াছড়ি। সারা দিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ক্লান্ত প্রেমিক লিখছে প্রেমিকাকে, ভাই লিখছে বোনকে কিংবা করপোরেট অফিসের বস লিখছে তাঁর সুন্দরী কলিগকে। আজকের দিনে এসেও মানুষ মানুষকে চিঠি লিখছে। কি দারুণ, তাই না!
আজ আর লিখব না। শেষ একটা নিবেদন রাখবে? এক গোধূলিনামা স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় আসবে কি ক্যাফেটেরিয়া পেরিয়ে টংদোকানে? অনেক দিন হয় তোমার উষ্ণ ঠোঁটে চায়ের কাপে চুম্বন দেখি না।
ইতি
নিত্য শুভার্থী প্রেমিক
বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা