জগৎ সংসারে ছিন্ন মায়ার শৈশব ‘কালো মেঘের ভেলা’

মৃত্তিকা গুণ পরিচালিত ‘কালো মেঘের ভেলা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যসংগৃহীত

‘টোকাই’ শব্দটা স্মৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভবঘুরে, ঠিকানাহীন, ছিন্নমূল মানুষ যারা নিজেরাই এই সুন্দর সভ্যতার পৃথিবীতে আঁস্তাকুড়ে আবর্জনায় পরিণত হয়, এই সুন্দর পৃথিবীর ফেলে দেওয়া আবর্জনা কুড়িয়ে পিঠের আস্ত বস্তায় ভরে নিয়ে মহাকালের দাসের মতো রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়—তারা সবাই টোকাই।

ছোটবেলায় বাংলাদেশে এই শব্দটার সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলাম। চট্টগ্রামের জে এম সেন কিন্ডারগার্ডেন প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় বার্ষিক অনুষ্ঠানে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় আমার এক সহপাঠী বন্ধু টোকাই সেজেছিল। হাইস্কুলের এক দাদা শিব সেজেছিল আর আমাকে ব্রাহ্মণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। আমি বাবার ধুতি পরে, পৈতে গলায় বাড়ি থেকে আনা শঙ্খ ঘণ্টা হাতে নিয়ে তার সামনে পূজা করতে বসেছি। ১৩ বছর বয়সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে সেই আমিও হঠাৎ শৈশবে ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু, দেশান্তরী হয়ে গেলাম। পশ্চিমবঙ্গে এসে নতুন অনেক শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলাম ঠিকই! তবে অন্য অনেক শব্দের মতো ‘টোকাই’ শব্দটি কোথাও ব্যবহৃত হতে দেখিনি। কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা শিশুতোষ উপন্যাস ‘কালো মেঘের ভেলা’-এর সুন্দর চলচ্চিত্রায়ণ দেখতে গিয়ে স্মৃতির হাতছানিতে নতুন করে শব্দটা মনে পড়ে গেল।

‘কালো মেঘের ভেলা’ কালজয়ী উপন্যাসের চরিত্র দুখী। এই চলচ্চিত্রের দুখু, সে–ও এক টোকাই। যদিও পিঠে কাগজ কুড়ানি বস্তা নিয়ে সে ঘোরে না। রেল কলোনি, বস্তিবাসী, ছিন্নমূল অন্ধকার জীবনের শৈশব, মাথার ওপরে তার এই তীব্র অসাম্যের পৃথিবীর কালের বোঝা। দুখু নামক জীবন-পোড়া শিশুটির মনস্তাত্ত্বিক জগৎ এতটা বড়, দুখুকে দেখতে দেখতে কখনো আবার সত্যজিৎ রায়ের অপুকেও মনে পড়ছিল। দুখু নামক চরিত্রটিকে শিশু না ভেবে এই পৃথিবীর সব বয়সের ছিন্নমূল, যাযাবর মানুষের প্রতিনিধিও ভাবা যেতে পারে। যাযাবরদের স্থায়ী কোনো ঘর থাকে না। ঘরবন্দী শিশুদের মতো চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে বেড়ে উঠতে হয় না। মরণ-কামড়ের অনিশ্চিত পৃথিবীটা এমনিতেই অনেকটা বড় হয়ে যায়।

দুখুকে ঘরে মায়ের সঙ্গে দেখে সৎবাবা যখন মা এবং ছেলে দুজনকেই তিরস্কার করছিল, দুখু বলে উঠেছে, ‘তোমাদের এই লাস্ট ক্লাস ঘরে আমার মতো ফার্স্ট ক্লাস পোলা মুতবার আয়ে না।’

কবি নির্মলেন্দু গুণের কন্যা কবি মৃত্তিকা গুণ বহুমুখী চিন্তাধারার ফলন সুন্দর এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। শৈশবে বাবার উপন্যাস পড়ে দুখী চরিত্রটিকে ভালো লেগে গিয়েছিল, অনেকগুলো বছর এই দুখীর সঙ্গে মনে মননে সহাবস্থান করতে করতে বেড়ে ওঠা কবি মৃত্তিকা ভাবলেন, কবিতা লেখার পাশাপাশি এবার চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করবেন। সারা জীবন অন্তরে বয়ে চলা সেই দুখীকে দিয়েই তাই প্রথম শুরু করলেন। মৃত্তিকার প্রথম চলচ্চিত্র সেদিক থেকে বহু বছরের সাধনার ফসল। বহু বছরের দুঃখ যাপনের ফসল। দুঃখের সঙ্গে সহাবস্থান করে যে সে–ও তো দুখী হয়। ধরে ধরে গোটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সময়ও নিয়েছেন বেশ। মৃত্তিকার সঙ্গে কবি নির্মলেন্দুর উপন্যাসের চিত্রনাট্য নির্মাণ করেছেন ফারুক হোসেন।

কবি, চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের অনেক কবিতা যেমন পড়েছি, চলচ্চিত্রও দেখেছি। বুদ্ধদেব ক্যামেরার চোখ দিয়েও কবিতা নির্মাণ করতেন। বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রগুলো দেখতে দেখতে আবার পরিচালক অঞ্জন দাসের নির্মাণে জয় গোস্বামীর ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’ জাতীয় চলচ্চিত্রগুলো দেখে, কোনো কবির রচনা অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে জানতে পারলে কবিতার উপকরণ, মুহূর্তগুলো কতটা উঠে আসছে, তা আমার জানতে ইচ্ছা হয়। কবিতাকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করার সুযোগ যখন আছে তা করা হবে না–ই বা কেন? আবার কবির যেকোনো লেখার মধ্যেও কবিতার ছায়া এসে যায়। চলচ্চিত্রেও সেই ছায়াগুলো ফুটে উঠুক। কবি মৃত্তিকার চলচ্চিত্রেও এ রকম কিছু দৃশ্য দেখেছি। যেমন স্টেশনে একটা ছেঁড়াফাটা ঘুড়ি টাঙানো ছিল। এই ছেঁড়াফাটা ঘুড়িটি তো ছিন্নমূল দুখুরই রূপক সাদৃশ্য। আবার দুখুর মা যখন ছেলেকে ধরে রাখতে না পেরে অসহায়, ট্রেনে তুলে দেয়—ঘরের অসুস্থ, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে অনেকেই যেভাবে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসে; দুখুও জীবনের অজানা এক স্টেশনে এসে নামে। সেই গ্রামে দুখুর এক বন্ধু হয়। বন্ধু একদিন একটা পাখির ছানাকে ধরে আনে। রেলগাড়ির শব্দ শুনলেই অপুর মতো দুখুরও শহরে যেতে ইচ্ছা হতো। মায়ের কথা মনে পড়ত। পাখির ছানাকে দেখে দুখু বলে ওঠে, ‘ওরে মনে হয় ওর মা খুঁজতেছে, চলো ওরে ওর মায়ের ঘরে রাইখা আসি।’

মৃত্তিকা আসলে দুঃখ, কান্না, আনন্দ, বেদনার মাধ্যমে একটা সহজ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছেন। ছোট-বড় সবার ভালো লাগার মতো একটি চলচ্চিত্র। কঠিন বিষয়কে সহজ পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

মায়ের কথা মনে পড়লেই যে দুখুর নিজেরও বুকটা ফেটে যায়। মরে যেতে ইচ্ছা করে। লুঙ্গি পরে খেতে বসে, মুখে ভাত নিতে নিতে মায়ের কথা মনে পড়াতে দুখু যেভাবে কাঁদছিল, নাইমুর রহমান আপনের অভিনয়ের সেই দৃশ্য চিরকাল মনে থাকবে। এই শিশুশিল্পী বাংলাদেশের সম্পদ। ওকে যত সুন্দর করে ব্যবহার করা যায়, অভিনয় সত্তাকে বার করে আনা যায় মৃত্তিকা নিজের বুকে ওঠা চারা, আদর-যত্নে-মমতায় ফুল ফোটানো মালাকারের মতো চেষ্টা করে গিয়েছেন। দুখুর মা রোজীর চরিত্রে রুনা খান দুখুকে যেভাবে পরম পবিত্র স্নেহে ‘ও বাবা! বাবা...’ বলে ডেকে ওঠেন, আর্তনাদ আহাজারি করে ওঠেন বুকের গভীরে গিয়ে পিনপতনের শব্দের মতো করে তা বাজে। এই ডাক আমাদের চিরকালীন মায়েদের ডাক। ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর আমিও আমার উদ্বাস্তু মাকে হারিয়েছি। মৃত্তিকার চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে আমার চোখে জল চলে এসেছে।

আবার দুখুর মতো একটা বস্তির ছেলের মুখের নায়কোচিত যথাযথ সংলাপগুলো আমাদের আনন্দও দেয়। দুখুকে ঘরে মায়ের সঙ্গে দেখে সৎবাবা যখন মা এবং ছেলে দুজনকেই তিরস্কার করছিল, দুখু বলে উঠেছে, ‘তোমাদের এই লাস্ট ক্লাস ঘরে আমার মতো ফার্স্ট ক্লাস পোলা মুতবার আয়ে না।’ সৎবাবা দুখুকে দুচোখে দেখতে পারে না। মায়ের ওপর অত্যাচার করে। দুখুকে যখন বলে, তোর শরম নাই? এত বারণ করা সত্ত্বেও বারবার এই ঘরে চলে আসিস। দুখু মুখে মুখে জবাব দেয়, ‘শরম তো আমার বাপের লগে মইরা গেছে। মা বেশরম তোর মতো কুত্তার লগে বিয়া করছে।’ আবার অন্য একসময় এই একরত্তি ছেলেটা দুঃখ করে মাকে বলছে, ‘তুমি কালামরে না ছাইড়া আমারে ছাড়লা মা? নিজের পেডের পোলারে আপন না কইরা সোয়ামিরে আপন করলা!’

দুখু শুধু ঘরে নয়, স্টেশনেও সবার চোখে হিরো। ছোটা মাস্তান। একজন যাত্রী মাথায় বস্তা তুলে দিতে চাইলে, সে বলে ওঠে, ‘এই দুখু কোনো সময় বস্তা কাঁধে লয় নাই’। ছোট্ট হিরোকে না চিনতে পারা যাত্রীকে বলে ওঠে কোথা থেকে চলে আসা ‘ফাউল পাবলিক’! রসিক কবি নির্মলেন্দু গুণ যে একজন ক্রীড়ামোদী মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন ফেসবুক পোস্ট দেখে বুঝতে পেরেছিলাম।

ছোট মুখে বড়দের মতো আবার জ্ঞানের কথাও থাকে। গ্রামে বন্ধুর সঙ্গে এক সাধকের কাছে গিয়ে সে এসব শুনেছে। যে বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল, সেই বাড়ির গিন্নিমাকে কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছে, ‘দুনিয়ার সবচাইতে বড় খুনি কে জানেন? মায়া! মনটা যদি মায়ার লগে গিট্টু দিয়া রাখেন তাহলে সারা জীবন দুঃখ পাইতে হইব। গিট্টু খুইলা দেন আর মেঘের মতো উইড়া বেড়ান!’ গিন্নিমার মুখের ঝামটা শুনে পরক্ষণেই বলে ওঠে, ‘জ্ঞানের কথা কইছি, একটু ভাইবা দেইখেন।’ ছোট মুখে এ ধরনের সংলাপ আমাদের বেশ আনন্দ দেয়। হাস্যরসের সঞ্চার করে।

মৃত্তিকা আসলে দুঃখ, কান্না, আনন্দ, বেদনার মাধ্যমে একটা সহজ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছেন। ছোট-বড় সবার ভালো লাগার মতো একটি চলচ্চিত্র। কঠিন বিষয়কে সহজ পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

‘চাচা সাইডে চাপেন নইলে খবর আছে...’ দুখুর কণ্ঠে চলচ্চিত্রে সুন্দর মজার একটি গানও আছে। আফ্রিকার দরিদ্র কালো বর্ণের শিশুদের নাচের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। এই শিশুদের ভালো ঘরবাড়ি, পোশাক কিছুই নেই। কিন্তু মনের আনন্দ গোটা পৃথিবী মাতিয়ে দিয়েছে। মৃত্তিকার চলচ্চিত্রে মজার গানটির সঙ্গে বস্তির দরিদ্র ছেলেমেয়েদের নাচ একই রকম মনে হয়েছে।

সুন্দর মনোমুগ্ধকর গ্রামের রাত্রিকালীন পালার আসরে ‘আর আমারে মারিস নে মা..’ গানটিও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজেও চলচ্চিত্রের জন্য সুন্দর একটি গান লিখেছেন, ‘ইস্টিশানে জন্ম আমার রেলগাড়িতে ঘর/ রেলের চাকায় বান্দা আমার লোহারই অন্তর।’ দুখু চরিত্রের মূল কথাগুলো গানের কথায় বুঝে নেওয়া যায়। ক্যামেরার বুনে চলা গ্রামবাংলার দৃশ্য, দৃশ্যের কবিতা, চোখ জুড়িয়ে দেয়, মন ছুঁয়ে যায়। কবিতার রূপক উপমাগুলো আরও একটু বেশি করে ডানা মেলুক, কবি মৃত্তিকার কাছে প্রত্যাশা থাকবে।

একদিন সব কালো মেঘের ভেলা আলোর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে পৃথিবীতে। মাটি পুষ্ট হবে। কারও শৈশব আর ছিন্নমূল, দুঃখ ভারাক্রান্ত, দুর্বিষহ হয়ে উঠবে না। দুখুদের জীবনের কষ্ট দিয়ে আমরা সবার বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে পারব। সেই স্বপ্নের সন্ধানে লড়াই, সৃষ্টিযাত্রা অব্যাহত থাকুক। মৃত্তিকা আমার বাংলাদেশের মাটি। এই মাটির সৃষ্টি আমার মাথায় থাকুক।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত