অনিন্দিতা,
কেউ কাউকে এতটা অবহেলা করতে পারে, তোমার সঙ্গে দেখা না হলে জানা হতো না। বোঝা হতো না, কথা না বলে পাশে না বসে আমিও রুক্মিণীর মতো ভালোবাসতে পারি। যে কারণে চিঠিটি তোমাকে লিখছি, তা বলার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলি। খুব সম্ভবত তখন ক্লাস সেভেনে কি এইটে পড়ি। বাড়ির সামনে ছিল খরস্রোতা হরিহর নদ। স্কুল থেকে ফিরে বরশি দিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। কালেভদ্রে দু–একটা ঠোঁক বরশিতে মিললেও মাছ তুলতে পারতাম না, ছুটে যেত। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতাম। তেমনই একদিনের ঘটনা, বাড়ি ফিরে মন খারাপ করে বসে আছি। চোখ–মুখ শুকনা দেখে মা বললেন, ‘কিরে আজও নিশ্চয়ই মাছ ছুটে গেছে। মাছ পাসনি! একটা মাছ ধরতে পারিস না, বড় হয়ে কী করে খাবি। চিন্তা নেই, বড় হ একটা ধীর-স্থির মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। যে তোরে সামলে রাখবে, আগলে রাখবে।’ বাকিটা বলতে লজ্জা করছে তাও বলি। মায়ের মুখে ওই কথা শোনার পর থেকে প্রায় একটা মেয়েকে স্বপ্নে দেখতাম। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে মুখের চেহারা মনে করতে পারতাম না। হাসি–মশকরা শুনতে হবে ভেবে কথাটা কাউকে কখনো বলিনি। তোমাকে কেন বললাম? কারণ, স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি তুমি। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। প্রথম তোমাকে যেদিন স্কুলে দেখি। তারপর কোনো দিন ঘুম থেকে উঠে মুখ মনে করতে কষ্ট হয়নি। আজও চোখ বুজলেই তোমার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাই।
নিশ্চয়ই পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছি, ভাবছ। ই-মেইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের যুগেও কাগজ–কলমে চিঠি লিখছি। আসলে ব্যাপারটা কী ঘটেছে জানো? গতকাল মহাদেব সাহার ‘তোমার থিসিস’ শিরোনামের কবিতাটি পড়ে কেবল অভিভূতই হইনি। কবিতাটি রীতিমতো আমাকে ভাবিয়েছে। কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করছি। ‘থিসিস লিখছ বলে লিখবে না/ একটি প্রেমের চিঠি/ কী করে বোঝাই থিসিসের চেয়ে/ একটি প্রেমের চিঠি কম মূল্যবান নয়।’ বেশ কিছুদিন হলো থিসিসের পাঠ চুকেফুকে গেছে। কিন্তু প্রেমের চিঠি তো লেখা হয়নি। জানি, আমাকে ভালোবাসো না, কোনোদিন হয়তো বাসবেও না। তারপরও তুমি ছাড়া কেউ তো আর নেই, যাকে লিখতে পারি।
জানি না বিশ্বাস করবে কি না। তবে এটিই সত্যি—প্রেম, ভালোবাসা কী, কেমন, কীভাবে হয়—এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি। তাই সার্থক প্রেমের চিঠি লেখার কৌশলও রয়ে গেছে অজানা। এমন কি তোমাকে লেখা এই চিঠিটিকেও চিঠি–বিশেষজ্ঞগণ সার্থক প্রেমের চিঠি হিসেবে যে গণ্য করবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। না করুন, একটি ব্যর্থ প্রেমের চিঠি হিসেবে পরিগণিত হলেও দয়া করে উত্তর দিয়ো।
ট্রাফিক জ্যামের ভিড় ঠেলে বাসে ঝুলে ঝুলে বাসায় ফেরার পর ক্লান্তি নিবারণে আমার তোমাকে দরকার। ভাড়া বাসার ভেন্টিলেটারে জমে থাকা ঝুল তোমার একা পরিষ্কার করতে হবে না। ঝুল ভাঙার দায়িত্ব আমিও নেব। আমার ঠান্ডার বাতিক নেই। তুমি ভিজতে চাইলেই বৃষ্টিতে ভিজতে পারব। না, রাজনৈতিক নেতার মতো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না। দোষে-গুণে মানুষ, গুণগুলো ভালোবেসে দোষগুলো ক্ষমা করে দিয়ো।
আশ্চর্য হয়েছ? ভাবছ যেখানে ভালোবাসাবাসিই নেই, সেখানে দোষ-গুণ বিচারের প্রশ্ন আসছে কেন। না, তোমার ভাবনায় ভুল নেই। তবে কি জানো? ছাদের কার্নিশে বল্লার চাক দেখে গৃহকর্ত্রী যখন ভাঙতে উদ্যত হন। বাঁচার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে বল্লাগুলো উড়ে গিয়ে গৃহকর্ত্রীকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। আমার কথাগুলোও তেমনই, শেষবারের মতো তোমাকে মায়ার ফ্রেমে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা ধরে নিতে পারো। আমি জানি, যে যে যোগ্যতা থাকলে আমাকে অবহেলা করতে পারতে না। ফেসবুক রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ দিতে। তার একটিও এই মুহূর্তে আমার নেই। বেকার জীবনে পদার্পন করেছি আজ ২৮ দিন হলো। এই কয়েক দিনেই পৃথিবীটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতেও যে ভালো কিছু হবে, নিশ্চিত করে সে কথা দিতে পারছি না। কিন্তু মন বলছে, ভালো কিছু করব। এই আশ্বাসে নয়, ভালোবাসার জন্যে যদি ভালোবাসতে পারো, আমাকে একটি সুযোগ দিয়ো। মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। তোমাকে বলতে চেয়েও বলতে পারি না, মেসেজ লিখেও ব্যাকস্পেস চেপে ধরি। তোমাকে কেউ হয়তো কখনো বলেনি। তুমিও হয়তো জানো না, সাদা অ্যাপ্রনে তোমাকে সরস্বতীর মতো দেখায়। আর কিছু বলার নেই। বারবার ভালোবাসি বললে নিজেকে খুব সস্তা মনে হয়। বলো, তোমাকে যে ভালোবাসে, তার কি সস্তা হওয়া মানায়?
সৌমেন্দ্র গোস্বামী
২৮.০৮.২০২৩