বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, যেন সবুজের আলপনা। নয়াডাঙ্গা গ্রাম। নর্ত ছোট একটি নদী। গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বহূদুর। বৈশাখ মাস হাঁটুপানি নিয়ে নদী তার সৌন্দর্য ধরে রেখেছে। নদীর পশ্চিম পাড়জুড়ে বড় একটি শালবন। বনের ভেতর অর্ধেক মাইল ব্যবধানে, আদিবাসীদের ছোট দুটি পাড়া। মাটির বাড়ি। তাদের কয়েকজন জাল নিয়ে নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত।
কড়া রৌদ্র নিয়ে সকালের সূর্য ওপরে উঠছে। নদীর পূর্ব পাড়ে কেউ সেচের কাজে, কেউ নিড়ানি, কেউ সার ছিটানোয় ব্যস্ত।
কলিমুদ্দিন মুন্সির একমাত্র পুত্র আবদুন নূর। একজন কর্মঠ যুবক, পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো ধান করেছে। সকাল থেকে অন্যান্য কৃষকের মতো সে–ও সেচ কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
ফয়েজ তালুকদার এই গ্রামের মানুষ। একসময় গ্রামেই থাকত। কয়েক বছর হলো শহরের বাড়িতে থাকে। তালুকদার সাহেবের প্রায় পঞ্চাশ একর জমি গ্রামের বেশ কিছু মানুষ বর্গা চাষ করে খায়।
বিয়ের পর বকুলকে উপহার হিসেবে কিছুই দেওয়া হয়নি। অভাবের সংসার। এবার ফসল তুলে বকুলকে সোনার চেইন উপহার দেওয়ার মনস্থির করে আবদুন নূর।
কলিমুদ্দিন মুন্সি সারা জীবন এই পাঁচ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে মাটির সঙ্গে সংগ্রাম করে দুনিয়া থেকে হঠাৎ এক দিনের ডায়রিয়ায় বিদায় নিল।
বাবার সঙ্গে আবদুন নূরও প্রতিদিন এই জমিতে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। বাবার মৃত্যুর তিন মাস পর বর্গা জমির ফসলের টাকা তালুকদার সাহেবের বাড়িতে দিতে গেলে তালুকদার সাফ কথা জানিয়ে দেন, ‘এ বছর থেকে জমি আর বর্গা দেওয়া হবে না। তোমরা যারা জমি বর্গা করছ, এখন থেকে বছর চুক্তা নিতে হবে। যারা যত বিঘা জমি চাষ করো, বিঘাপ্রতি বিশ হাজার টাকা জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।’
এই নিয়ম সব বর্গাচাষিকে জানিয়ে দেন তালুকদার সাহেব। টাকা পরিশোধ করে বাড়িতে ফিরে আসে আবদুন নূর। মাথাভর্তি দুশ্চিন্তা! পাঁচ বিঘা জমি এক বছর চুক্তির পরিমাণ এক লাখ টাকা। এত টাকা কোথায় পাবে সে? খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকা ছাড়া হাতে কিছু নেই।
বিকেলে শহর থেকে বাড়িতে ফেরে আবদুন নূর। এক বছরের ছোট শিশু রতনকে বারান্দায় ঘুম পাড়িয়ে স্ত্রী বকুল বাবার দেওয়া গরুটিকে খুদি-গুঁড়া খাওয়াচ্ছে। দুই বছর আগে দেওয়া এঁড়ে বাছুর এখন বড় একটি ষাঁড়ে পরিণত হয়েছে। আবদুন নূর মলিন মুখে বারান্দায় মাটির ওপর বসে। বকুল কাছে আসে। শাড়ির আঁচল দিয়ে স্বামীর মুখ ও কপাল মুছে দেয়। জিজ্ঞেস করে—
‘মন খারাপ? তালুকদার কটু কথা বলেছে নাকি?’
আবদুন নূর চুপ করে থাকে। গরুটির দিকে গভীরভাবে তাকায়। এই গরু ছাড়া তার আর কোনো সহায়–সম্বল নেই।
প্রচণ্ড গরম। বকুল হাতপাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করে। বারান্দায় শিশুর পাশে শুয়ে ক্লান্ত আবদুন নূর ঘুমিয়ে পড়ে।
রাতে ভাত খাওয়ার পর বিছানায় বসে আবদুন নূর। হাতে পান দেয় বকুল। স্বামীর পা টিপে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা বলো তো, তালুকদারের বাড়ি থেকে আসার পর তুমি মনমরা হয়ে গেছ কেন? কী হয়েছে তোমার?’
‘আমার বাপ-দাদারা তালুকদারদের জমি বর্গা করে জীবনধারণ করেছে। বাবার সঙ্গে আমিও ওই জমিতে সংগ্রাম করেছি। ছোট তালুকদার সাফ কথা জানিয়ে দিল, এখন থেকে জমি আর বর্গা দেবে না। জমি নিতে হলে চুক্তা নিতে হবে। বিঘাপ্রতি বিশ হাজার টাকা, বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধ করতে হবে। এই জমির সঙ্গে আমার বাপ-দাদার সম্পর্ক। এই জমির সঙ্গে আমাদের খাওয়া-পরার সম্পর্ক। জমি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, কী করে খাব? মানুষের কামলা করা ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকবে না, বকুল।’
বকুল স্বামীর কথা শুনে কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর বলে, ‘দুশ্চিন্তা করতে হয় না। দুশ্চিন্তা সমাধান দেয় না, বরং স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। আল্লাহ কোনো একটা উপায় করে দেবেন।’
‘শোনো বকুল, এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে সুযোগ বুঝে অন্য মানুষ ওই জমি চুক্তা নিয়ে নিবে। টাকা আমাদের নেই। কিন্তু কত মানুষ জমি চুক্তা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে!’
বকুল বলে, ‘দুশ্চিন্তা না করে বাড়ির ষাঁড়টা বাজারে নিয়ে যাও।’
আবদুন নূর এতক্ষণে স্বস্তি পায়। কম করে হলেও এই ষাঁড়ের এক লাখ টাকা দাম পড়বে। গরুর টাকা দিয়ে জমি চুক্তা নেওয়া যাবে।
এত দিন গরুটিকে সন্তানের মতো যত্ন করে বড় করেছে বকুল। ওদিকে আবদুন নূর সারা দিন মাঠে কর্মে ব্যস্ত থাকত। এদিকে বকুল বাড়িতে গরুটিকে যত্ন করে বিশাল ষাঁড়ে পরিণত করেছে। আবদুন নূর ভাবে, গরুটার জন্য বকুলের খুব কষ্ট হবে। কিন্তু কোনো উপায় যে নেই।
পরদিন বাজারে নেওয়ার জন্য গরুটিকে বাড়ি থেকে বের করার সময় বকুলের চোখ থেকে টপ টপ করে অশ্রু ঝরে। শাড়ির আঁচল দিয়ে সে চোখ মোছে। গরুটাও যেন বুঝতে পারে, বাড়ি থেকে তার চিরবিদায়। জোর করে সে বাড়ির দিকে ফিরে আসার চেষ্টা করে। বকুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। গরুটারও চোখ থেকে পানি ঝরছে। ওদের বাক্শক্তি নেই, কিন্তু উপলব্ধি যে আছে, আবদুন নূর তা বুঝতে পারে।
গরুটিকে নব্বই হাজার টাকায় বিক্রি করে আর কিছু টাকা ঋণ করে চুক্তির টাকা পরিশোধ করে আবদুন নূর।
দুপুর গড়িয়ে যায়। কড়া রোদ। আবদুন নূর শ্যালো মেশিনে দুহাতের তালু ভরে পানি পান করে। খেতের পাশে মেঠো পথ, বেলগাছের ছায়ায় বসে সে। বারবার ফসলের দিকে তাকায়, দেখে মুগ্ধ হয়।
বিয়ের পর বকুলকে উপহার হিসেবে কিছুই দেওয়া হয়নি। অভাবের সংসার। এবার ফসল তুলে বকুলকে সোনার চেইন উপহার দেওয়ার মনস্থির করে আবদুন নূর। বকুলের কষ্টের কথা মনে পড়ে তার!
পুরো খেতে সেচ দেওয়া শেষ হলে, সন্ধ্যা নাগাদ বাড়িতে ফেরে আবদুন নূর।
ক্লান্ত দেহ। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে সে।
ভোররাতে মসজিদের আজান ভেসে আসে। হঠাৎ মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ, সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস। শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে থেমে যায় বাতাস ও শিলাবৃষ্টি।
ততক্ষণে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। চারদিক ফরসা হয়ে আসে। অনেকের মতো আবদুন নূরও ফসলের মাঠের দিকে ছোটে। ভুট্টার খেত মাটির সঙ্গে মিশে গেছে! বোরো ধানের শীষ পানির ওপর ভাসছে!
মানুষের আহাজারি। আবদুন নূর ফসল দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। বুকফাটা নীরব কান্নায় ফসলের মতো চৌচির হয়ে যায়। মুহূর্তেই তার সব স্বপ্ন ভেঙে হাহাহারে পরিণত হয়। আকাশের দিকে তাকায় আবদুন নূর। স্রষ্টার বাণী মনে পড়ে—
‘আমি তোমাদের ভয়, ক্ষুধা ও ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। যারা ধৈর্য ধারণ করবে, তাদের জন্য রয়েছে পুরস্কার।’
আবদুন নূর চোখ মুছতে মুছতে বাড়িতে ফেরে।
পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও