স্মৃতিতে বাবা

অলংকরণ প্রথম আলো

সেদিন সকালে মায়ের কণ্ঠে ভারী হয়ে ওঠা আহাজারির শব্দে ঘুম ভাঙে। বাইরে গিয়ে দেখি অসুখের ভারে নুয়ে পড়া বাবার ক্লান্ত দেহটা সুপারিগাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। সেই দাঁড়ানোয় শেষ দাঁড়ানো হবে কখনো ভাবিনি। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল তাঁর সময় হয়তো আর বেশি নেই। তাই বলে যে সেদিনই আসবে মৃত্যুদূত, তা ছিল ভাবনাতীত।

বাড়ির দুই হাত উঠান, পুরোনো সুপারিগাছ আর টিনের গেটের মড়মড় শব্দের মধ্যে বাবাকে খুঁজি। ভীষণ রাগী বাবা আমার টিউবওয়েলের হাতল উঁচু করে রাখলে কিংবা দরজার ছিটকিনি ঠিকমতো না দিলে রেগে যেতেন। সংসারের প্রথম মৃত্যু তিনি। তাঁর অসুস্থতার সময় গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে বুকটা হু হু করে উঠত। কল্পনায় ভাসত বাবার মৃত্যু। আমাদের উঠানজুড়ে শত শত মানুষ তাঁর প্রাণশূন্য দেহখানা দেখতে এসেছে।

কয়েক দিন এমন হয়েছিল, গোরস্থানের পাশের রাস্তা দিয়ে আসতেই ভয় হতো। তারপর সময় গেল সময়ের নিয়মে। বাবা চলে গেলেন। গোরস্থানে এখন আমি নিয়মিত যাই। কয়েক শ মুদ্রার পাশে জীবিত আমি একা প্রাণ। তবু ভয় হয় না। অন্য জগতের এই বাসিন্দাদের দূরের কেউ মনে হয় না। বাবা ছিল ডায়াবেটিসের রোগী। কিডনি বিকল হয়ে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান। তাঁর মৃত্যুর ১৫ থেকে ১৬ দিন পর মায়ের ভীষণ জ্বর। কোনোভাবেই সারছে না। পাশের জেলা ফরিদপুরের বড় ডাক্তারকে দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডায়াবেটিস ধরা পড়ল, সঙ্গে ক্রিয়েটিনিনের (কিডনির সুস্থতা নির্ণয়ের পরিমাপক বলা যেতে পারে) পরিমাণও আশঙ্কাজনক। চোখে অন্ধকার দেখার জোগাড়। বাবার পর এখন মা অসুস্থ। তখন ভয় করত, মা হয়তো বেশি দিন বাঁচবে না। ভাবতাম এ জীবনটাই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। সুস্থ, অসুস্থ প্রত্যেক মানুষ অপেক্ষায়। তাই এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই, যা হওয়ার তা–ই হবে।

এভাবে গেল দুই বছর। বাবার স্বপ্ন, মায়ের স্বপ্ন সত্যি হলো। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমি এখন আমার জন্মভূমি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে থাকি। বাড়িতে কথা হয় মুঠোফোনে। আজ ফোন দিয়ে জানতে পারলাম মায়ের শরীরে টিউমার হয়েছে। আগামীকাল তাঁর অপারেশন। জানি এতে ভয়ের কিছু নেই। তবু নিজেকে বোঝাতে পারছি না। বিভিন্ন রকমের চিন্তাভাবনা মাথায় এসে জড়ো হচ্ছে। ওরা আমায় ঘুমাতে দিচ্ছে না, ঠিকমতো খেতেও দিচ্ছে না। মৃত্যুর প্রতি যে ভয় তখন কেটে গিয়েছিল, তা এখন আবার হয়। সময়ের ফেরে মৃত্যুভয় আবার এসেছে। মানবজীবন সত্যি বদলায়। মুখ লুকিয়ে হয়তো হাসে সময়।

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়