অদৃশ্য হাত

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

শিফা রাতে ঘুমাতে ভয় পায়। ঘুমে প্রচণ্ড রকমের ভয় কাজ করে। তাই সজাগ থাকার যথাযথ চেষ্টা করে সে। চোখের পাতা দুটো এক হলেই ভয়ানক বিপদ! অন্ধকারে একটা বিশ্রী হাত খুঁজে বেড়ায় তাকে। যে হাতটার মুখোমুখি হতেই চায় না সে। দমবন্ধ হয়ে আসে। সেদিন রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল, ‘মা, মানুষ না ঘুমিয়ে বাঁচতে পারে না?’ মা শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘এসব আবার কী ধরনের প্রশ্ন রে, ঘুমিয়ে যা। সকালে স্কুল আছে।’

সেদিনও আবার ঘুমের ঘোরে হঠাৎ লাফিয়ে জেগে ওঠে। একই স্বপ্ন। একটা হাত। স্পর্শ করতে চায়। সারা গা ঘামতে থাকে। অস্থির হয়ে চুপচাপ বিছানার এক কোণে বসে থাকে গুটিসুটি মেরে। কান্না করে একা একা। খুবই ভয়ানক সে অনুভূতি। কাউকে আর বলতে পারে না।

একদিন দুপুরে স্বপ্নের অস্পষ্ট ছবিও এঁকেছে ব্যক্তিগত ড্রয়িং খাতায়। সেই হাতটা। যেটা অন্ধকারে তার দিকে এগিয়ে আসে। এ ঘটনার শুরু খুব বেশি দিন আগে না। স্কুলবাস মিস করেছিল। বাবার সঙ্গে বাসে করে আসছিল বাসায়। বাসে প্রচণ্ড ভিড়। ভাড়া দেওয়ার সময় বাবা তার হাতটা ছেড়েছিল একবারের জন্য। তখনই হাতের ফাঁক দিয়ে একটা হাত তার বুক বরাবর চলে আসে। একটা কুচকুচে কালো হাত। ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে। ততক্ষণে হাতও সরে যায়। এই ধাক্কা ভুলতে ভুলতে আরেক দিন মার্কেটের ভিড়ে একই অনুভূতি। একটা হাত তার শরীর ছুঁয়ে যায়।

শিফা এবার ক্লাস এইটে। গুরুগম্ভীর স্বভাবের। একটু ভীতু। কিছু মানুষ থাকে, কাউকে কিছু বলতে পারে না, এই টাইপের। হাতের স্পর্শের এই কথা জানে শুধু তার বান্ধবী টুম্পা। অদৃশ্য এই হাতের সঙ্গে সেও পরিচিত। এমন ঘটনার শিকার হয়েছে কয়েকবার। মা বলেছিল সাবধানে থাকতে। কাঁধের ব্যাগটা সামনে রাখতে। একই জিনিস শিফাকেও সে শিখিয়ে দিয়েছে। ব্যাগ সামনে রেখে যে খুব একটা উপকার পেয়েছে, তা নয়। একটা হাত সুযোগ পেলেই যেন শরীর খুঁজে নেয়। রাতে ঘুমের মধ্যে সেই দৃশ্যের অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। একটা হাত তাকে তাড়া করে বেড়ায়। কুচকুচে কালো হাত। যেটা সম্পূর্ণ বোবা বানিয়ে দেয় তাকে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় বান্ধবীদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে আসে কিছুটা পথ। তারপর যা হওয়ার তাই, জ্বর। জ্বরের ঘোরে প্রলাপে শুধু একটা কথা, ‘না না, আমাকে ধরবেন না, এই হাতটা সরাও কেউ...।’

মায়ের এক জোড়া কোমল হাত মেয়েকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে। দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। একমুহূর্তের জন্য তার নিজেরও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েকে হাত থেকে বাঁচানোর সময় এসে গেছে, সেটা এত দিন কেন টের পাননি তিনি।

শিফার জ্বর সেরে ওঠে। মাকে আবারও একদিন প্রশ্ন করে, ‘মা, মানুষ না ঘুমিয়ে বাঁচতে পারে না?’ মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে একটা গল্প শোনায় তাকে, কলেজে পড়াকালীন বাসে তিন বান্ধবী মিলে এক লোকের হাত ভেঙে দেওয়ার গল্প। যে হাতটা বারবার পেছন থেকে স্পর্শ করছিল তাদের। শিফা আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় টের পায় না। শুধু স্বপ্নে যে হাতটা এগিয়ে আসে তার দিকে আজকে, সেটা সেও তার মায়ের মতো আটকে দেয়। একটা অদৃশ্য শক্তি পায়। হাতটা সরে যায় পেছন থেকে।

মিরপুর ১০, ঢাকা