বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা

লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রস্থল বাংলাদেশ একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সম্মুখীন হচ্ছে এবং এর মূলে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই) রূপান্তরকারী শক্তি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা, অসুবিধা, প্রতিবন্ধকতা এবং সুযোগগুলোকে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশে এআইয়ের সম্ভাবনা

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: এআই বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে। রুটিন কাজগুলোর স্বয়ংক্রিয়তা, প্রক্রিয়াগুলোর বিশেষায়িতকরণ এবং এআই-চালিত সমাধানের প্রবর্তন দক্ষতা এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতা বৃদ্ধিতে এআই অবদান রাখতে পারে।

শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: শিক্ষায় এআইয়ের একীকরণ শিক্ষার্থীদের শিখন-শিক্ষণ অভিজ্ঞতায় বিপ্লব ঘটাতে পারে। আধুনিকীকৃত শিক্ষার মাধ্যম এবং এআই-সহায়ক পাঠদান প্রয়োজনমাফিক শিক্ষা প্রদান করতে পারে। জ্ঞান বিকাশে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত প্রয়োজনগুলো অপেক্ষাকৃত সাবলীলভাবে মোকাবিলা করতে পারে। এ ছাড়া এটি ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখাসহ ভবিষ্যতের চাকরিবাজারের চাহিদার জন্য তরুণদের প্রস্তুত করতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা অগ্রগতি: এআই-চালিত স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা রোগনির্ণয়, চিকিত্সা এবং রোগীর যত্ন উন্নত করতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে; যেখানে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে একটি সমস্যা, এ ক্ষেত্রে এআইয়ের মাধ্যমে দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রোগনির্ণয় এবং রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নির্ধারণ করে সাফল্য অর্জন করতে পারে।

কৃষিবিপ্লব: বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এআই পরিষেবা ব্যবহার করে সমৃদ্ধ হতে পারে। স্মার্ট চাষের কৌশল, শস্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণ এবং এআই-চালিত কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ কৃষিক্ষেত্রকে সহায়তা করতে পারে। এর মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কৃষকদের আয় বাড়ানো সম্ভব।

অসুবিধা ও প্রতিবন্ধকতা

চাকরি স্থানচ্যুতি: এআই ঘিরে প্রাথমিক উদ্বেগের মধ্যে প্রধান হলো চাকরি স্থানচ্যুতির সম্ভাবনা। বাংলাদেশের মতো একটি উল্লেখযোগ্য শ্রমশক্তির দেশে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পের দ্রুত স্বয়ংক্রিয়তা সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়তে পারে।

নৈতিক বিবেচ্য বিষয়: এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে গোপনীয়তা, পক্ষপাতিত্ব এবং জবাবদিহি–সম্পর্কিত বিষয় বিবেচ্য। বাংলাদেশের মতো একটি সমাজে, যেখানে গোপনীয়তা আইন এখনো অবাধ ও মুক্ত, সেখানে দায়িত্বশীল এআই স্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য দৃঢ় নৈতিক নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

অবকাঠামো এবং প্রবেশাধিকার: এআইয়ের সফল বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী প্রযুক্তিগত অবকাঠামো প্রয়োজন। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় প্রায়ই প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট সংযোগ এবং আইটি–সামগ্রীর অভাব, যা ব্যবহারকারীদের মধ্যে সমান সুযোগ নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়। সার্বিক উন্নয়নের জন্য এআই প্রযুক্তিতে ন্যায়সংগত প্রবেশের সুযোগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানানসই এআই প্রযুক্তি গ্রহণে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এআই সমাধানের প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য সমস্যা

নিম্ন ডিজিটাল সাক্ষরতা: বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ডিজিটাল সাক্ষরতা ও সচেতনতার ব্যবধান রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান–নির্বিশেষে ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি এবং এআইয়ের সুবিধা সবার কাছে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। এআই প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেল এবং প্রাথমিক সতর্কতা–ব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা সৃষ্ট নির্দিষ্ট সমস্যা মোকাবিলায় এআই সমাধানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা দেশের জন্য একটি অনন্য বিবেচনা।

সরকারি নীতিমালা: বাংলাদেশে এআইয়ের নিয়ন্ত্রক–কাঠামো এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। নৈতিক বিবেচনার সঙ্গে উদ্ভাবনের ভারসাম্য রক্ষা করে, দায়িত্বশীল এআই বিকাশ এবং স্থাপনা নিশ্চিত করে এমন নিয়মনীতি প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে।

এগিয়ে যাওয়ার উপায়

শিক্ষায় বিনিয়োগ: এআইয়ের সুবিধা কাজে লাগাতে, শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এর মধ্যে এআই-সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে একীভূত করা এবং শিক্ষার্থী ও পেশাদার উভয়ের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রদান অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

গবেষণা এবং উদ্ভাবন প্রচার: এআই–বিষয়ক গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা অপরিহার্য। একাডেমিয়া, শিল্প এবং সরকারের মধ্যে সহযোগিতা এআই বিকাশের জন্য একটি সমৃদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। এআই স্টার্টআপগুলোর জন্য তহবিল গঠন এবং উদ্ভাবন সহযোগিতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

নৈতিক এআই অনুশীলন: এআইয়ের বিকাশ এবং স্থাপনা নৈতিক নীতির দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। এর মধ্যে রয়েছে নির্ণায়ক যন্ত্রের পক্ষপাত দূর করা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করা। শিল্পমালিকদের সহযোগিতায় নৈতিক এআই অনুশীলনের জন্য সরকারের তদারকিতে একটি কাঠামো স্থাপন করা উচিত।

অবকাঠামো উন্নয়ন: গ্রামীণ এলাকায় এআই ব্যাপকভাবে গ্রহণের জন্য ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোতে এআই প্রযুক্তির একীকরণকে সহজতর করা যেতে পারে।

জনসচেতনতামূলক প্রচারণা: এআই এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ভ্রান্ত ধারণা দূর করে। এ বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।

পরিশেষে এআইকে ভয় না পেয়ে, প্রতিপক্ষ না ভেবে একে সহযোগী হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে স্বীয় কর্মনিপুণতা ও কর্মসক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। যা আপনাকে আত্মবিশ্বাসী ও সময়োপযোগী হতে সহায়তা করবে।

তথ্য ও যোগাযোগ সম্পাদক (২০২২–২০২৩), বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ