মায়ের গয়না

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না সুবিমল বাবুর। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। অনেক কষ্ট করে মানুষ হয়েছেন। চোখ বন্ধ করলেই সেসব দিনের ছবি দেখতে পান। জীবনের গল্প শুনতে চাইলে কলেজজীবনের ঘটনা শুরুতে বলেন প্রত্যেককে।

‘উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণের ডেট দিয়েছে। বাড়ি এসে বাবাকে বললাম। জবাবে তিনি কিছু বললেন না। রাতে বই পড়ছি, কানে এল মাকে বাবা বলছেন, কী করে যে খোকার ফরম পূরণের টাকা জোগাড় করি। কতজনের কাছে চাইলাম, কেউ দিতে রাজি হয় না। বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা আনব? আমাদের তখন টিনের ঘর ছিল। মা বললেন, আমার কানের জিনিস বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসো। খোকা মানুষ হলে আমারে গয়না কিনে দেবে। ওই রাতে আর পড়িনি। সারা রাত কেঁদেছি। প্রতিজ্ঞা করি, মাকে নতুন কানের দুল বানিয়ে দেব। কিন্তু সেই ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দুই মাসের মাথায় মা মারা যান।’

দুই ছেলে-মেয়ে প্রতিষ্ঠিত, বিদেশে থাকেন। ঢাকায় নিজের বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে একাই থাকেন সুবিমল বাবু। সরকারি বড় কর্মকর্তা ছিলেন। এখন অবসর। ইদানীং রাতে ঘুম হচ্ছে না, দিনে ঘুমান। এ নিয়ে তিনি নিজের ওপর বিরক্ত।

‘রিটায়ারমেন্টের পর মানুষ বোধ হয় কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়।’ সহধর্মিণীর এমন মন্তব্যে দুঃখ পেয়েছেন সুবিমল বাবু। অবশ্য মিথ্যে বলেননি। শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে চাকরি শেষে মানুষ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন।

রাত দুইটা বাজে। ছাদে বসে আছেন সুবিমল বাবু। অন্ধকার বড় মায়াবী। কাকতালীয় ঘটনার মতো কত কী ঘটে অন্ধকারে। হঠাৎ কান্নার শব্দ কানে এসে লাগছে। ভদ্রলোক জীবনে বহু কেঁদেছেন, এখন আর কান্নার শব্দ সইতে পারেন না। শব্দটা ছাদের ঘর থেকে আসছে।

ছাদের এক অংশে ছোট্ট একটি ঘর। সেটিতে কম বয়সী এক ছেলে থাকে, চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে, টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। দরজায় নক করতে গিয়েও সুবিমল বাবু থামলেন। এত রাতে কথা বলা ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতেই পর পর তিনবার কলবেল চাপলেন। ছেলেটা দরজা খুলে দাঁড়াল। সুবিমল বাবু সহাস্যে বললেন, ‘ঘুম আসছে না। ভাবলাম, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি। তবে তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্য স্যরি।’ কথা গড়াল অনেক দূর। একপর্যায়ে কান্নার প্রসঙ্গ তুললেন সুবিমল বাবু। কোনোরকম ভণিতা না করে ছেলেটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলা শুরু করল, ‘বাবা নেই। মা অনেক সংগ্রাম করে আমাকে বড় করেছেন। শহরে আসার আগে টাকা ছিল না। একদিন মা তাঁর স্বর্ণের চুড়ি দুটো আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা বিক্রি করে শহরে যা। মায়ের জোরাজুরিতে নিতে বাধ্য হলাম। শহরে এসে একটা টিউশনি পেয়ে যাই। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। বেশ কিছু টাকা জমিয়ে মায়ের জন্য এক জোড়া চুড়ি কিনি। বাড়ি যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। হঠাৎ একদিন ফোন এল, মা অসুস্থ। বাড়ি পৌঁছার আগেই তিনি না–ফেরার দেশে চলে যান। চুড়িগুলো মাকে আর দিতে পারিনি।’ সুবিমল বাবুও কাঁদলেন, কিছু বললেন না।

সাংগঠনিক সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা