নীল রেইনকোট

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

অর্পিতা ধানমন্ডির একটি পুরোনো ফ্ল্যাটবাড়ির তৃতীয় তলায় থাকে। ফ্ল্যাটটা খুব বড় নয়, দুই কামরা। একটায় সে থাকে, আরেকটা প্রায় ফাঁকা পড়ে থাকে। রান্নাঘরে প্রতিদিন চুলা জ্বলে না। ফ্রিজে রাখা দুধ আর ব্রেড দিয়েই চলে যায় দিন।

ব্যাচেলর মানুষদের জীবন এমনই। কখনো এককাপ চায়ের সঙ্গে একটুকরা শুকনা বিস্কুট কিংবা একমুঠো মুড়ি খেয়ে কেটে যায় একটা দিন। অর্পিতার জীবন যেন ঘড়ির কাঁটার মতো। নিয়মিত, স্থির এবং প্রতিদিনই এক নিঃশব্দ প্রতীক্ষায় আবর্তিত। প্রতিদিন বিকেল ৫টা ২০ বাজলেই সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কেউ যেন কথা দিয়েছিল, ঠিক এই সময়েই আসবে। কিন্তু কে? কে কথা দিয়েছিল? কার জন্য এই নিত্য প্রতীক্ষা?

অর্পিতা কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সে অপেক্ষা করে একটি মুহূর্তের, একটি দিনের, একটি সম্ভাবনার কিংবা একটি রঙের। সেই রংটা নীল।

তখন বর্ষাকাল। বাইরে ঝুমবৃষ্টি। অর্পিতা কাকভেজা হয়ে নীলক্ষেতের একটি পুরোনো বইয়ের দোকানে আশ্রয় নেয়। কিছু বইও কেনা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয়, শৈশব থেকেই। পড়ার টেবিলে একটি খোলা ‘গীতবিতান’ সব সময় পড়ে থাকে, যেন বইটাও নিশ্বাস নেয় তার সঙ্গে। অর্পিতার বাবা অনিল বাবু ছিলেন রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র৷ রবীন্দ্রসংগীতে পারদর্শী ছিলেন তিনি। অর্পিতার গানের হাতেখড়িও বাবার হাত ধরেই। ভার্সিটির সমাবর্তনে তার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিল।

বইয়ের দোকানে ঢুকে ‘শেষের কবিতা’র একটা পুরোনো সংস্করণ হাতে নেয় সে। পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখে, বুক ভরে নেয় নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় সুগন্ধি।

হঠাৎ সে টের পায়, পাশে বসা একটি ছেলে তার এই ছেলেমানুষি দেখছে মুগ্ধ হয়ে। ছেলেটির লম্বা চুল, গায়ে নীল রেইনকোট, চুল বৃষ্টিতে ভেজা, শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে একরকম বৃষ্টির গন্ধ। ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ প্রিয়? সব সময় কি তাঁরই বই কেনেন? কখনো কি মনে হয় না, রবিঠাকুরের প্রেম একঘেয়ে?’
অর্পিতা কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। ছেলেটি আবার বলল, ‘শুনছেন? আমি শুভ্র। বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’
অর্পিতা মৃদু হাসল। তারপর বিল পরিশোধ করে দোকানের সামনে দাঁড়াল। রিকশা খুঁজছে। কিন্তু বাইরে তখনো বৃষ্টি। রিকশা নেই৷ দূরে একটা রিকশা দাঁড়ানো, চালককে দেখা যাচ্ছে না।

শুভ্র পাশের টংদোকান থেকে দুই কাপ চা নিয়ে আসে। একটা কাপ অর্পিতার হাতে দেয়। চা দিতে দিতে বলে, ‘জানেন, এই দোকানের মামার ভাষায়, বৃষ্টির দিনে যদি ভেজা বই আর এককাপ চা না হয়, দিনটা নাকি শুভ হয় না।’
অর্পিতা এবার বিরক্ত হয়নি। বরং একটু অবাক হয়। ছেলেটা অদ্ভুত, কিন্তু বিরক্তিকর নয়। তার কথা বলায় একধরনের স্বাভাবিক রসবোধ আছে, কোনো কৃত্রিমতা নেই। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে।

কিছুক্ষণ কথা হয় তাদের। খুব সাধারণ কিছু কথা। দুপুরের গায়ে লেগে থাকা অলসতা কিংবা শীতের সন্ধ্যায় এককাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ের মতো নিরিবিলি আর একটু ঘোরলাগা। বই নিয়ে কথা হয়, সিনেমা নিয়ে কথা হয়, বৃষ্টি আর চা নিয়ে কথা হয়।

বৃষ্টি কমে এসেছে। আকাশ এখনো ধূসর, ছায়াগুলো হালকা। শুভ্র উঠে দাঁড়ায়। ওর রেইনকোটের হাতা থেকে পানি টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে। শুভ্র অর্পিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘আজ আমি যাই, টিউশন আছে। যদি আবার দেখা হয়, চিনবেন তো?’
অর্পিতা মুচকি হেসে বলল, ‘অবশ্যই চিনব। আপনি যদি নীল রেইনকোট পরে থাকেন, তবে নিশ্চিত চিনে ফেলব।’
এ কথা শুনে শুভ্র এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর হালকা মাথা নাড়ে, ‘ঠিক আছে। যদি কোনো দিন ফিরি, এই নীল রেইনকোট পরেই ফিরব।’

শুভ্র চলে যায়। অর্পিতা তাকিয়ে থাকে তার চলে যাওয়া পথের দিকে, যতক্ষণ না মোড় ঘুরে চোখের আড়াল হয়।

তারপর কেটে যায় অনেক দিন। অর্পিতা বারবার ফিরে যায় সেই দোকানে, সেই টংয়ের পুরোনো বেঞ্চিতে। এখন আর কেউ আসে না, সে একা। সঙ্গে এককাপ ধোঁয়া ওঠা চা। প্রতিদিন বিকেলে নীলক্ষেতের ৮ নম্বর গলির সেই দোকানের আশপাশে ঘোরে। টংদোকানে বসে চা খায় শুভ্রর মতো করে। একটা খালি চেয়ার সব সময় পাশে রাখে, যেন শুভ্র এলে বসতে পারে। কয়েকবার দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ওই দিন যে ছেলেটা এসেছিল, চা এনেছিল আমার জন্য; আপনি চেনেন?’
দোকানদার মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘আপা, প্রতিদিন অনেকেই তো আসে। কজনকে চিনে রাখব?’

অর্পিতা জানে না, শুভ্র আদৌ আসবে কি না, কোথায় থাকে, কী নামে ফেসবুক আইডি—কিছুই না। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, খুঁজে পাওয়া নয়, এই অপেক্ষাই হয়ে উঠেছে তার জীবনের একমাত্র সত্য। এখন আর কোথাও যায় না সে। না কারও কাছে, না সেই বইয়ের দোকানে, না টংদোকানে চা খেতে। শুধু প্রতিদিন বিকেল ৫টা ২০ বাজলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। পুরোনো ভঙ্গিতে একই দৃষ্টিতে। বৃষ্টি হলে তার ভালো লাগে। কারণ, বৃষ্টিতে রেইনকোট পরা মানুষ বেড়ে যায়। একদিন হঠাৎ রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক লোককে দেখে বুকটা ধড়াস করে ওঠে। নীল রেইনকোট পরে লোকটা হাঁটছে। হাঁটার ধরনটাও শুভ্রর মতো। অর্পিতা দৌড়ে নিচে নামে। গেট খুলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকে—
‘অ্যাই শুভ্র শুনছেন…?’

পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, গাজীপুর বন্ধুসভা