পদ্মকুটিরে একদিন

প্রতীকীফাইল ছবি প্রথম আলো

পলি মাঝেমধ্যেই না বলে হারিয়ে যায়। এক অন্যরকম আদিখ্যেতা। দিন দশেক পর হঠাৎ করেই রান্নাঘরের পেছনটায় এসে নজর কাড়ে ‘ম্যাঁও’ বলে। ছোটাছুটি করে দুধের বাটিসমেত হাজির হই। ‘ও পলি, এতদিন কোথায় ছিলি? আমরা তোকে কত খুঁজেছি! পুরোনো ঠাকুরবাড়ির তিনতলার ভাঙা আস্তানায় পর্যন্ত গিয়েছি তোর খোঁজে, পাইনি।’ আমি বলতে লাগলাম। পলি তখনো খাবার কুড়াতেই ব্যস্ত। দুধের বাটি রেখেই এক লাফে আমার কোলে। কমফোর্ট জোনটুকু সবাই খোঁজে। পলিও তা-ই।

পলি আমাদের পালিত বিড়াল। টেংলা পাহাড় থেকে সামনে এগোলেই নিমাই নদী। তার পাশেই ঘনবন। বনের ধারেই ঋষিপাড়া। সংসার বৈরাগী হওয়ার অনন্ত দীক্ষা নিতে গিয়ে পলির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। আমার সব কথা সে বুঝতে পারে। সে মানুষের মতো কথা বলে। হাসে, কাঁদে। রাগলে হিংস্র হয়ে ওঠে। কিন্তু ভালোবাসায় গলে যায়। চুপটি করে মুখ লুকিয়ে রাখে বুকের ভেতর। আমিও আদরে গলে যাই। পলি ঠিক আমাকে বুঝতে পারে। কিটি, পিউ, মিমি বিড়ালছানাদের খবরও রাখে। বনবাঁদারের সব পশুপাখির সংখ্যা, কার প্রিয় খাবার কী, সবই সে জানে। আরও জানে মহাবিশ্বের সবকিছু, গ্রহ নক্ষত্রের খবরও!

আমার ছোটবেলা থেকেই ভয়ডর কম। একাই ঢুকে পড়লাম পদ্মকুটিরে। সুনসান নীরবতা।

আমার জেওরপাতি পরে লালবউ হওয়ার শেষ ইচ্ছাটুকুও সে জেনে ফেলেছে। তিতাসপাড়ে ‘জোৎস্নাঘর’-এর স্বপ্নটুকুও। আমি কিন্তু বলিনি। সে মাইন্ড রিড করতে পারে। কৌশলটুকু নিজেই রপ্ত করেছে। টোকা দিলেই তথ্য বের হয়। এবার সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হওয়ার মূলমন্ত্রটুকু পলি থেকেই জেনে নেব নিশ্চয়ই। মিসগাইড করবে না, হলফ করেই বলতে পারি।

পলিকে খুঁজতে খুঁজতে অনেকটা পথ চলে এসেছি। সেই যে সকালে দুধরুটি খেয়ে বেরিয়েছে আর ফেরার নাম নেই। দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়িয়েছে। মাইলখানেক হেঁটে আশুতোষ ডাক্তারের বাড়ি পার হয়ে পদ্মকুটিরের পেছনটায় ধানখেতের আইল বেয়ে হাঁটছি। পেছনে হিন্দু পোড়াবাড়ি, তালপুকুর, দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ—আমাকে আরও সংসারত্যাগী ভাবনায় মাতাল করে তুলছে। অতি সৌন্দর্য়টুকুও বেসামাল ঠেকছে। আর নিতে পারছি না। রাশি রাশি সবুজ, পাখির কলকাকলি, শ্যালো মেশিনে ধানখেতে দেওয়া জল, দূরে গামছাশাড়ি পরা কিষানী, হাতে জগভর্তি পানি আর পোনামাছের ছালুন দিয়ে একথালা কড়কড়া ভাত! আহা! মিষ্টি রোদটুকু ঘোষণা দিচ্ছে জীবন এক আশ্চর্য মাদক।

পদ্মকুটিরের কাছাকাছি চলে এলাম। পদ্মপুকুরে ঘেরা বিশাল বড় পদ্মকুটিরে এক জমিদার বাস করত। সাধারণ চাষাভূষাদের রক্ত চুষে খেত। বাড়ির পেছনের বটগাছটায় ছোটখাটো অপরাধ বা বিনা অপরাধে অসহায় মানুষদের গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হতো। জমিদার, শোষকশ্রেণির ভয়ে উঠতি বয়সী নারীরা পালিয়ে বেড়াত। নজরে পড়লেই খুবলে খেত। অন্যায়ভাবে বাড়িঘর জমিজিরাত দখল করত লুটেরার দল। জমিদার খিলখিল করে হাসত। তার নির্দেশেই সব হতো। রাতভর চলত মদ–জুয়ার আসর। নাচনেওয়ালীর নাচ ও বাঁধভাঙা আর্তনাদ। নাচতে নাচতে কাচঘর রক্তাক্ত হতো। পাঁজর ফুঁড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মিশে যেত পদ্মকুটিরের শত বছরের অভিশপ্ত শ্যাওলাপড়া দেয়ালে। নিমাই নদীর বেফানা জলে। ঠান্মির কাছে গল্প শুনেছি পদ্মকুটিরে জিন থাকে। কেউ একা গেলে ঘাড় মটকে ফেলে। রাতে কারা যেন চিৎকার করে কাঁদে, বাঁচাও! বাঁচাও। হায়েনার মতো বিকৃত ভঙ্গিতে হা হা হা করে হাসতে থাকে চৌধুরী সাহেব! পাপিষ্ঠ জমিদার! নারীদেহ খুবলে খেয়ে স্তন কেটে ফেলে দিত নিমাই নদীতে। রক্তে সয়লাব হওয়া নিমাই নদী আজও জানান দেয়, মেয়েরা আঁতুড়ঘরেই নির্যাতিত। মাটির তলেই তারা নিরাপদ!

আমার ছোটবেলা থেকেই ভয়ডর কম। একাই ঢুকে পড়লাম পদ্মকুটিরে। সুনসান নীরবতা। বারান্দা পার হয়ে শ্যাওলাপড়া পৌরাণিক একটি ঘরে ঢুকতেই এক বিশাল দেহের কংকাল হাউ মাউ করে আমাকে ধরতে আসছে! খারাপ মানুষের চেয়ে কম ভয়ংকর এক গোখরা দূর থেকে ছোবল মারার অপেক্ষায়, লেজে পা দিলেই গোগ্রাসে গিলে খাবে। চৌধুরী শাহানশাহ দাঁত বিজলাচ্ছেন। মানুষের মাংস খাওয়াই তার ধর্ম। এ জন্যই সে জন্মেছে! আমার ঘাড় মটকানোর জন্য চৌধুরী এক পা, দুই পা সামনে এগিয়ে আসছে। টেনেহিঁচড়ে নিমাই নদীতে ভাসিয়ে দিতে চাইলেই চিৎকার করে উঠে দেখি মা আমার মাথায় জল ঢালছেন। পলিটা বুকের কাছে ওম দিচ্ছে! ‘মা, আমি এখানে কীভাবে এলাম’, বলতেই মা রেগে গিয়ে বললেন ‘পদ্মকুটিরে ভূতপ্রেত থাকে, ভয়ংকর একটা জায়গা, ঐখানে কেউ একা যায়? আজ তোমার পরিতোষ কাকাই তোমাকে বাঁচিয়েছে।’ পরিতোষ কাকা জানালেন, পদ্মকুটিরে ঢোকার সময় উনি আমাকে দেখে ফেলেন। উনি তখন জমিতে কাজ করছিলেন। পাড়ার অন্য এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মকুটিরে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে দেখতে পান। আমার দুই হাত দুই পাশে পড়ে আছে। মুখ দিয়ে ফেনা ঝরছে! দুজন মিলে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।

জানালা দিয়ে জোৎস্না গলে পড়ছে ঘরজুড়ে। ভাবছি, কী অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলাম। ঐ নির্জন পদ্মকুটিরে দৈত্য দানব, সাপবিচ্ছুর অভাব নেই। অত্যাচারী চৌধুরীর প্রেতাত্মা এখনো মানুষের রক্ত মাংস লুটেপুটে খায়। মরলেও খাসিলত বদলায় না। খারাপ মানুষের জীবাশ্ম থেকে তৈরি হয় হাজারো খারাপ মানুষ। বিধ্বস্ত ভাবনায় এলোমেলো হতেই পলি বলল, ‘আর কখনো হারিয়ে যাব না, দেখে নিয়ো তোমার কাছাকাছিই থাকব। পদ্মকুটিরে খারাপ মানুষ থাকে, ওখানে আর যেয়ো না।’ আজও পলি মানুষের মতোই কথা বলছে। আমি ভাবলাম, খারাপ মানুষের সান্নিধ্যই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্দিত্ব। পলি তাও রিড করতে পেরেছে। মাথা নেড়ে জানান দিল। চাঁদগন্ধভরা আলোটুকু মনে মাখছি। আদুরে পলিটাও ততক্ষণে আমার বুক ঘেঁষে ওম পেতে শুরু করেছে।

ঢাকা, বাংলাদেশ