বাবা আমার কাঠফাটা রোদ্দুরে একচিলতে ছায়া

বাবা আমার কাঠফাটা রোদ্দুরে একচিলতে ছায়াছবি: সংগৃহীত
মাইলখানেক যাওয়ার পর একটা গ্যাস পাম্পে গাড়ি থামান বাবা। হাতে চকচকে ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, কিছু খেয়ে আসো। আমিও ক্ষুধা সহ্য না করতে পেরে বিস্কুট, পাউরুটি, কলা আর একটা ড্রাই কেক খেয়ে পানি পান করলাম।

মধ্যরাত। ঢাকার পথে বাবা আর আমি। বাবা ড্রাইভ করছেন, আমি পাশে বসে। সিরাজগঞ্জ শহরে গিয়ে তিনি বললেন, হোটেলে কিছু খেয়ে নাও। আমি বললাম, চলো দুজনই খেয়ে আসি। খিদে নেই বলে জানালেন। আমিও আর খেতে যাইনি।

মাইলখানেক যাওয়ার পর একটা গ্যাস পাম্পে গাড়ি থামান বাবা। হাতে চকচকে ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, কিছু খেয়ে আসো। আমিও ক্ষুধা সহ্য না করতে পেরে বিস্কুট, পাউরুটি, কলা আর একটা ড্রাই কেক খেয়ে পানি পান করলাম।

গাড়ি আবার ছুটে চলেছে। আমি বললাম, ‘সেই বিকেলে একসঙ্গে খেয়েছি। তোমার এখনো ক্ষুধা পায়নি?’ জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, পেয়েছে একটু! তবে এখন খেলে ঘুম আসবে, সারা রাত গাড়ি চালাতে হবে।’ আমি চুপ হয়ে গেলাম। ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠল। চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে রাস্তার গাছপালা দেখছি এবং বাবার কষ্টের কথা ভাবছিলাম।

হঠাৎ কড়া একটা ব্রেক! সামনের সিটের সঙ্গে জোরে একটা ধাক্কা খেলাম। বাবা বললেন, বিপরীত পাশ থেকে একটা বাস সামনের বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে আমাদের গাড়িকে প্রায় ধাক্কা দিচ্ছিল। অল্পের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলাম। গা শিয়রে ওঠল। ‌ ইতিমধ্যে রাস্তায় দুটি দুর্ঘটনা দেখে এসেছি। বাবা বললেন, ‘চিন্তা করো না। এসব প্রতিদিনকার স্বাভাবিক ঘটনা।’

বাবাদের ত্যাগের কোনো সীমারেখা নেই। হাইওয়েতে বড় বড় গাড়ির হ্যাজাক আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সামনে ঝাপসা। চোখ স্বাভাবিক হতেই মিনিটখানেক লেগে যায়। বাবা বললেন, চশমা লাগাও। অথচ ওনার চোখে কোনো চশমা নেই। রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। আমাকে বললেন ঘুমাতে, নয়তো সকালে মাথাব্যথা করবে আবার। এদিকে বাবাকে সকাল ছয়টার মধ্যে বিমানবন্দর পৌঁছে যাত্রী নিয়ে আবার গন্তব্যে রওনা দিতে হবে।

আমি তখন ঢাকা কলেজে পড়ি। একবার ছুটি শেষে কলেজে ফিরছিলাম। আমার বাবা মাইক্রোবাসচালক। ভেবেছিলাম, ওই দিন আর ঘুমাব না। ওনার সঙ্গে সারা রাত চোখ খুলে কাটিয়ে দেব। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। একটু পর বাবা ডেকে বললেন, ওঠো সকাল হয়ে গেছে। ‌ তার মানে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম, বাবা চোখে পানি দিচ্ছেন। এভাবেই বাবাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের গল্পগুলো আড়ালে থেকে যায়। ওই দিন বুঝেছি বাবাদের শরীরের থেকে মন বেশি পরিশ্রমী। ওনাদের কাছে বয়স শুধু একটা সংখ্যামাত্র। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সন্তানকে একটু ভালো রাখার জন্য নিজেদের বিলিয়ে দেন। বাবা আমার কাঠফাটা রোদ্দুরে একচিলতে ছায়া। ভালোবাসি বাবা, অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায়।

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়