সৈয়দ আব্দুল হক আকন্দ থেকে উকিল মুন্সী
মরমি বাউল সাধক উকিল মুন্সী ১৮৮৫ সালের ১১ জুন নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামের এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম সৈয়দ আব্দুল হক আকন্দ। ডাকনাম উকিল। পিতার নাম সৈয়দ গোলাম রসুল আকন্দ ও মাতা সৈয়দা উকিলেন্নেসা। শৈশবে তিনি ঘেটুগানে যোগ দিলেও পরিণত বয়স থেকে মৃত্যু অবধি বাউল সাধনায় লিপ্ত ছিলেন।
মোহনগঞ্জ উপজেলার জালালপুর গ্রামে চাচা কাজী সৈয়দ আলিম উদ্দিনের বাড়িতে প্রায়ই তিনি বেড়াতে যেতেন। সেখানে ধনু নদের পাড়ের এক গ্রামে সাধারণ কৃষকের মেয়ে হামিদা খাতুনের প্রেমে পড়ে যান। এই প্রেম নিয়ে তিনি লেখেন ‘উকিলের মনচোর’ শিরোনামের একটি গান। তাঁর চাচা এই প্রেমের কথা জানার পর হামিদার বাবা সাধারণ কৃষক হওয়ায় পরিবার থেকে বাধা আসে। তিনি বাড়ি ছেড়ে শ্যামপুর, গাগলাজোর, জৈনপুরে ঘুরে বেড়ান। এরপর ১৯১৫ সালে জালালপুর গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের এক মসজিদে ইমামতি ও আরবি পড়ানোর কাজে নিযুক্ত হন। মুনশিয়ানা স্বভাবের জন্য মানুষ তাঁকে ভালোবেসে ‘মুন্সী’ উপাধি দেন। সেই থেকেই সৈয়দ আব্দুল হক আকন্দ থেকে তিনি উকিল মুন্সী নামেই সমাদৃত। পরবর্তী সময়ে হামিদা খাতুনের আগ্রহেই ১৯১৬ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তরুণ বয়সে ইমামতির পাশাপাশি তিনি গজল রচনা করতেন এবং রাত জেগে গাইতেন। রাতবিরাতে তাঁর গজল শুনে গ্রামের এক ব্যক্তি পুলিশের কাছে নালিশ করেন। পুলিশ ধরতে এলে উকিল মুন্সী পুলিশ নিয়ে গান গান। তাঁর অর্থবহ গান শুনে একপর্যায়ে পুলিশ উকিলের মুরিদ হয়ে যান।
বিচ্ছেদ গানের ধারায় হাওরপারে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ সমাদৃত। রচনা করেছেন প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ এবং বিরহের অনুভূতি ও অভিমান নিয়ে অনেক গান। সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসায় নিবেদন করেছেন অনেক গজল। নববধূর নাইওর যাওয়ার দৃশ্যটিকে তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে’ গানের মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদ ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে ব্যবহার করেছেন এই গান। এ ছাড়া তাঁর আরও অনেক গান বাংলা চলচ্চিত্রে সংযোজন হয়েছে।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের জৈনপুর গ্রামে উকিল মুন্সীর স্মৃতিসমাধি, ব্রিজ, সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা কাজে ২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালে শুরু হয়েছে। এতে একাডেমি ভবন, সমাধিস্থল সংস্কার, সীমানাদেয়াল, সংগ্রহশালা ও উকিল মুন্সী চত্বর নির্মাণাধীন।
১৯৭৮ সালের মাঝামাঝিতে উকিল মুন্সীর স্ত্রী হামিদা খাতুন এবং এর কয়েক মাস পর ছেলে সাত্তার মুন্সী মৃত্যুবরণ করেন। একই বছর তিনি অসুস্থ হয়ে ১২ ডিসেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন। মোহনগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের জৈনপুরের বেতাই নদের পারে চিরনিদ্রায় শায়িত হন উকিল মুন্সী।
সাবেক সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা