আদিকালে আনোয়ারা ছিল চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। আরাকান শাসনামলে দেয়াঙের সামন্ত রাজা আনাপোড়মের রাজকার্যালয় ছিল আনোয়ারায়। ১৬০৩ থেকে ১৬০৯ সাল পর্যন্ত আনাপোড়ম দেয়াঙের সামন্ত রাজার দায়িত্ব পালন করেন। ১৬০৯ সালের শেষের দিকে আপন ভাই আরাকানের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন আনাপোড়ম। ওই যুদ্ধে আনাপোড়মের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হলে তা পুড়ে যায়। এলাকাটিকে আনাপোড়া বলা হতো। কালের বির্বতনে আনাপোড়ম বিকৃত হয়ে আনাপোড়া থেকে আনোয়ারা নামের উৎপত্তি। আনোয়ারায় রয়েছে প্রাচীন জমিদারবাড়ি, প্রাচীন দিঘি, পুরোনো মসজিদ, মন্দির আরও কত কী!
আনোয়ারা থানার সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি বেলচূড়া গ্রামের কালাবিবি চৌধুরাণী জমিদারবাড়ি। বাড়ির বয়স প্রায় ৩৩৮ বছর। কালাবিবি চৌধুরাণী জমিদারবাড়িটি ১৬৮৫ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়। বেলচূড়া গ্রামে ছবির মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে কালাবিবির দিঘি। আনোয়ারা চৌমুহনী থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের পথ। কালাবিবির দিঘি বললে সবাই একনামে চেনে।
কালাবিবির দিঘি এলাকা থেকে মিনিট চারেক হেঁটে গেলে চোখে পড়বে পাখিডাকা, ছায়াঘেরা বেলচূড়া গ্রাম। রাস্তার উত্তর পাশে ছবির মতো বিশাল এক প্রাচীন বাড়ি। বাড়ির সম্মুখে সারি সারি সুপারি আর নারকেলগাছ। মেঠো পথের দুই পাশে দূর্বা ঘাস। বাড়ির সম্মুখে ছোট একটি পুকুর। পুকুরপাড়ে হরেক রকমের গাছ। একসময় নাকি পাখির অভয়ারণ্যও ছিল। বাড়ির পুকুর ও গাছপালায় পাখিদের মেলা বসত। বাড়ির দক্ষিণ পাশে কালাবিবি চৌধুরাণীর বিশাল প্রাচীন দিঘি। কালাবিবি চৌধুরাণীর বাড়ির আঙিনায় পেয়ারাগাছে সবুজ পেয়ারা ঝুলে আছে। দুই-একটা কাঠবিড়ালি পেয়ারা খেতে ব্যস্ত। বাড়ির দক্ষিণ পাশে জলপাই, গাব, পানিফল, পেঁপে আর আম–কাঁঠালের গাছ। কালাবিবি চৌধুরাণী জমিদারবাড়িটির আয়তন প্রায় ছয় কানি। প্রায় তিন গন্ডা জমির ওপর বাড়িটির অবস্থান।
আনোয়ারার শোলকাটা গ্রামে বসতি স্থাপনকারী শাহ সুজার সেনাপতি এবং পরবর্তীকালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রখ্যাত জমিদার শেরমস্ত খাঁ। শেরমস্ত খাঁর দুই মেয়ে কালাবিবি চৌধুরাণী, বুড়াবিবি চৌধুরাণী এবং পুত্র জবরদস্ত খাঁ প্রকাশ মনু মিয়া। কালাবিবি চৌধুরাণীর ছোট ভাই ছিলেন জবরদস্ত খাঁ, ডাকনাম মনু মিয়া। মনু মিয়ার সঙ্গে বাঁশখালীর সওদাগর–কন্যা মালকা বানুর প্রেমকাহিনি এবং প্রেম থেকে বিয়ে সবারই জানা। তাঁদের বিয়েকে কেন্দ্র করে মনু মিয়া ও মালকা বানুর লোকগীতি আজও চট্টগ্রামের বিয়েবাড়িতে শোনা যায়। গানটি আজও অনেক জনপ্রিয়, ‘মালকা বানুর দেশে রে বিয়ের বাদ্য আল্লা বাজে রে, মনু মিয়ার দেশে রে বিয়ার বাদ্য আল্লা বাজে রে, মালকার বিয়ে হইব মনু মিয়ার বিয়া হইব মালকা বানুর সাথে রে…।’ মালকা বানু ও মনু মিয়াকে নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে।
কালাবিবি চৌধুরাণী জমিদারবাড়ি থেকে এক মাইল দূরে মনু মিয়ার বাড়ি। কালাবিবি চৌধুরাণীর স্বামীর নাম ছিল রুস্তম আলী খান। রুস্তম আলী খানও জমিদার বংশের সন্তান। তিনি ছিলেন বড় উঠানের জমিদার দেওয়ান মনোহর আলী খানের পুত্র। কালাবিবি চৌধুরাণীর পিতা শেরমস্ত খাঁর মৃত্যুর পর বিশাল জমিদারবাড়ির দেখাশোনা ও তদারকির দায়িত্ব এসে পড়ে কালাবিবি চৌধুরাণীর ওপর। জবরদস্ত খাঁ প্রকাশ মনু মিয়া শৌখিন ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। জমিদারি টিকিয়ে রাখার জন্য কালাবিবি চৌধুরাণী বাবার জমিদারির হাল ধরেন। তাঁর অভিভাবক ছিলেন স্বামী রুস্তম আলী খান। কালাবিবি ছিলেন রুস্তম আলী খানের ২য় স্ত্রী। রুস্তম আলী খান ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও দানশীল ব্যক্তি। তিনি শাহ মোহছেন আউলিয়ার (রহ.) মাজারকে ভক্তি করতেন এবং মাজারের পরিচর্যা করতেন। রুস্তম আলী খান শেষ বয়সও মাজারে কাটিয়ে দেন এবং মৃত্যুর পূর্বে সবাইকে ওয়াদা করান যে তাঁর কবর যেন মাজারের পাশে হয়। হজরত মোহছেন আউলিয়ার মাজারের পূর্ব পাশে শুয়ে আছেন কালাবিবি চৌধুরাণীর জীবনসঙ্গী জমিদার রুস্তম আলী খান। আনোয়ারার সুফি সাধক হজরত মোহছেন আলী মাজার এলাকার বাসিন্দাদের জন্য রুস্তম আলী খান একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। কালের সাক্ষী বাজারটি আজও আছে, এটি রুস্তম আলীর হাট নামে পরিচিত। তবে তাঁর কবরটির স্মৃতিচিহ্ন নেই।
২০০৩ সালের ২৯ আগস্ট, দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম ‘সাহিত্য বিশারদের প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ এবং আলাওলের পদ্মাবতীর কথা’ শিরোনামে রুস্তম আলী খান ও জবরদস্ত খাঁ সম্পর্কে এক নতুন তথ্যের সন্ধান দিয়েছে। তাতে সাহিত্য বিশারদ আবদুল করিম সংগৃহীত মধ্যযুগীয় কবি আলাওল রচিত পদ্মাবতী পুঁথির একটি পাণ্ডুলিপিতে লিপিকার হিসেবে সৈয়দ আবদুল ওহাব, লিপিকাল ১১০৯ সন এবং পুঁথির মালিক ও সংরক্ষক রুস্তম আলী খান চৌধুরীর আওলাদ জবরদস্ত খাঁ চৌধুরীর নাম লিপিবদ্ধ আছে।
এই পাণ্ডুলিপির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। ১১০৯ সন বাংলা হলে ইংরেজিতে ১৭০৩ সাল, মঘী সন হলে হয় ১৭৪৭ ইং। চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন মঘী সন প্রচলিত ছিল। তাতে মনে হয়, সনটি মঘী সন হবে। সে হিসেবে পুঁথির গ্রন্থকাল ১৭৪৭ সাল হয়। জবরদস্ত খাঁ, রুস্তম আলী খান, নওয়াব হোসেন আলী খান, দেওয়ান মহাসিংহ—সবাই বিখ্যাত ব্যক্তি। পুঁথির তারিখ ১৭০২ বা ১৭৪৭ সাল, যা–ই হোক না কেন, পুঁথির মালিক জবরদস্ত খাঁ ওই সময় জীবিত ছিলেন। আপন বড় বোন কালাবিবি চৌধুরাণীর স্বামী রুস্তম আলী খানকে আওলাদে অর্থাৎ অভিভাবক হিসেবে দেখানো হয়েছে। জবরদস্ত খাঁ প্রকাশ মনু মিয়ার মৃত্যুর পর কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন কালাবিবি চৌধুরাণী। বিশাল সাম্রাজ্য ও অঢেল সম্পত্তির জমিদারি পরিচালনার ভার এসে পড়ে কালাবিবি চৌধুরাণীর ওপর। তিনি ধার্মিক ও বুদ্ধিমতী রমণী ছিলেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকের কথা, কালাবিবি চৌধুরাণী একজন মহিলা হয়ে জমিদারি পরিচালনার বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের নজরে আসে।
ব্রিটিশ সরকার কালাবিবি চৌধুরাণীর জমিদারবাড়ি পরিদর্শন করার জন্য রাজস্ব কর্মকর্তাসহ একদল সফরসঙ্গী নিয়ে দেয়াঙ বা আজকের আনোয়ারার বেলচূড়া গ্রামে আসেন। ব্রিটিশ রাজস্ব কর্মকর্তার উদ্দেশ্য ছিল কালাবিবি চৌধুরাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। ধর্মভীরু কালাবিবি চৌধুরাণী বিধর্মী ব্রিটিশ বেনিয়াদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তা নাছোড়বান্দা, দেখা করার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। একসময় রাজস্ব কর্মকর্তারা কালাবিবি চৌধুরাণীর দিঘিরপাড়ে তাঁবু টাঙিয়ে নাকি সাত দিন অপেক্ষা করেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই ব্রিটিশদের সঙ্গে দেখা করবেন না। একসময় ব্রিটিশরা রেগে যান এবং পরদিন কলকাতা শহরে ফিরে গিয়ে কালাবিবি চৌধুরাণীর জমিদারি সম্পত্তির অধিকাংশই বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। তারপরও চৌধুরাণী তাঁর নীতিতে অটল ছিলেন।
খাজনা নিয়ে আইনি লড়াইয়ে কালাবিবি চৌধুরাণী জিতে যান। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। পরে সাতকানিয়া থানার বাজালিয়া গ্রামের উচ্চবংশীয় খোদা বক্স নামক এক ছেলেকে পালক পুত্র হিসেবে দত্তক নেন। আবার এমনও কথিত আছে যে আসলে খোদা বক্স ছিলেন কালাবিবি চৌধুরাণীর বড় বোন বুড়াবিবি চৌধুরাণীর সন্তান। খোদা বক্স চৌধুরীর একমাত্র ছেলে এহসান আলী চৌধুরী। তাঁর আবার তিন ছেলে ও চার কন্যা। জান আলী চৌধুরী, সুজত আলী চৌধুরী ও মকবুল চৌধুরী। মেয়েদের নাম জানা যায়নি। জান আলী চৌধুরী ও মকবুল চৌধুরীর বংশধরের তথ্য পাওয়া যায়নি। সুজত আলী চৌধুরীর দুই সন্তান। আবদুল হাকীম চৌধুরী ও আশরাফ আলী চৌধুরী। আবদুল হাকিম চৌধুরীর একমাত্র সন্তান ওবাইদুল হক চৌধুরী এবং একটি কন্যাসন্তান। কন্যাসন্তানের নাম জানা যায়নি। ওবাইদুল হক চৌধুরীর চার সন্তান আবদুল মতিন চৌধুরী, আবদুল মান্নান চৌধুরী, আখতারুন নেছা ও আমিরুন নেছা।
জমিদারবাড়ির নতুন প্রজন্ম আবদুল মতিন চৌধুরীর ছোট মেয়ে চন্দনাইশের আমনতছপা বদরুননেছা মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক হুর নাহার চৌধুরী লিলি বলেন, ‘ছেলেবেলায় দেখতাম, গ্রামের লোকজন বাড়ির প্রবেশদ্বারে এসে জুতো হাতে নিয়ে প্রবেশ করতেন। মাথায় ছাতা থাকলে সে ছাতা বন্ধ করে বাড়িতে প্রবেশ করার রেওয়াজ ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ’৯১ সালের বন্যার সময় জমিদারবাড়িতে বন্যার্তদের জন্য লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল এবং বন্যাদুর্গত নিষ্পেষিত লোকদের খিচুড়ি খাওয়ানো হতো।
বাড়ির চারপাশে সবুজ গাছপালা, যতই দেখছিলাম ততই মুগ্ধ হয়েছি। কালাবিবি চৌধুরাণী জমিদারবাড়িটি দেখলে মনে হবে, এ যেন রানি কুটিরের আরেকটি ইতিহাস। জমিদারবাড়ির দ্বিতীয় তলায় একটি বড় কক্ষ আছে। নিচতলায় তিনটি বড় কক্ষ ও তিনটি ছোট কক্ষ এবং তিনটি ব্যালকনি। বাড়িটিতে ১৬টি জানালা এবং ১৪টি কারুকাজ করা দরজা রয়েছে। বাড়ির সিঁড়িও বেশ সুন্দর। পুরোনো কাঠের মধ্যে নকশা করা কিছু চিত্র চোখে পড়ল।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা
তথ্যসূত্র: দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস আদিকাল, লেখক জামাল উদ্দিন ও কালাবিবি চৌধুরাণী বাড়ির পুত্রবধূ ফরিদা ইয়াছমিন রুনু, প্রভাষক ও গ্রন্থাগারিক, এ জে চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ।