নতুন বাংলাদেশে বন্ধুত্বের জয়গান

নতুন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনতার বিজয় মিছিলছবি: খালেদ সরকার

মাত্র এক মাসে পৃথিবী–কাঁপানো এক বদলের সাক্ষী হলো দেশ। জাদুর কাঠির মতো বদলে গেল সব। ঘরকুনো ছেলেটাও দুরন্ত সাহসে রাজপথে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল তাজা বুলেটের সামনে। দুচোখে আগুন নিয়ে বলল, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ রংপুরের আবু সাঈদের বুক ঝাঁঝরা করেছিল যে বুলেট, আরও লাখো তরুণ-তরুণী সেই বুলেটবিদ্ধ হতে মরিয়া হয়ে পথে নামলেন। আর দেশের জন্য যাঁরা মরতে রাজি, তাঁদের দমায় সাধ্য কার! পারেনি কেউ। অবশেষে যে মুক্তির আশায় ঘর ছেড়ে, মায়ের হাতে মাখা ভাত রেখে আন্দোলনে নেমে এসেছিলেন আহনাফ, মুগ্ধরা—সেই মুক্তি এসেছে; তবে প্রায় ৭০০ জীবন আর বুলেটবিদ্ধ শরীরে নানা ক্ষত বয়ে বেড়ানো শত শত তারুণ্যের ত্যাগের বিনিময়ে।

এই যে এক ক্ষণ পরিবর্তনের সন্ধিকাল, এখানে তো বন্ধুরাই লড়েছেন! কাঁধে কাঁধ রেখে, হাতে হাত রেখে। আহত কিংবা নিহত বন্ধুকে টেনে সরাতে গিয়ে নিজে বুলেটে ঝাঁঝরা হতে একবিন্দু দ্বিধা করেননি বন্ধু। বন্ধুদের জন্য পানি নিয়ে তপ্ত রোদে হেঁটে বেড়ানো মুগ্ধ নিজেই শ্রান্ত শরীরে মাথায় বুলেট নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। আবার এই চূড়ান্ত মুক্তির পরও শুধু উদ্‌যাপনেই থেমে ছিল না বন্ধুত্বের মায়া। নিহত আর সংগ্রামী বন্ধুদের স্মরণে সারা দেশে গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনে ভরিয়ে তুলেছেন তো তাঁদের বন্ধুরাই! বন্ধুত্বের এমন মহামিলন আর তীব্র অনুভবই এই সফল আন্দোলনের মূলমন্ত্র, হয়তো বা আগামীর দেশ গড়ারও হবে।

বন্ধুত্বে কোনো চাহিদা থাকে না, থাকে না কোনো অভিলাষ। বন্ধু-স্বজন আর প্রিয় মাতৃভূমির জন্য নির্লোভ শ্রম আর সেবাই বন্ধুত্বের ধর্ম, আচার।

রোববার বিএফ শাহীন কলেজে একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার হলে শহীদ বন্ধু শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের নির্ধারিত আসনে তাঁর বন্ধুরা যে একগুচ্ছ ফুল আর তাঁর নাম লিখে স্মরণ করলেন, মনকে প্রবোধ দিলেন—‘দেখ্ আহনাফ! তুই আমাদের সঙ্গেই আছিস!’ এটাই তো বন্ধুত্ব! গত কয়েক দিনে রাত-দিন, রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারা দেশে তরুণ-তরুণীরা বন্ধুদের নিয়ে এক হয়ে যেভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বাজার তদারকি, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, দেয়ালে দেয়ালে নানা স্মৃতি আর কথা দিয়ে বন্ধুদের স্মরণ করলেন—বন্ধুত্ব তো এমনই হয়। বন্ধুত্বে কোনো চাহিদা থাকে না, থাকে না কোনো অভিলাষ। বন্ধু-স্বজন আর প্রিয় মাতৃভূমির জন্য নির্লোভ শ্রম আর সেবাই বন্ধুত্বের ধর্ম, আচার।

এই আচার মেনেই বন্ধুসভার হাজারের বেশি বন্ধু পুরোটা সময় যেভাবে দেশ গঠনের কাজে যুক্ত হয়েছেন, লড়েছেন, এখনো লড়ছেন, আমরা এ জন্য গর্বিত। সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই বন্ধুরা নিজ উদ্যোগে সর্বোচ্চ দিয়ে যুক্ত ছিলেন। বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ ও তার অব্যবহিত পরও তাঁরা স্বেচ্ছাসেবার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দেওয়া থেকে শুরু করে সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কন, সড়কের বিভিন্ন কাজে যুক্ত শিক্ষার্থীদের পানি ও খাবার বিতরণসহ আনন্দচিত্তে নিজেদের উদ্যোগে নানা কাজ করে গেছেন। বন্ধুরা শহীদদের স্মরণে সারা দেশ সবুজে ভরিয়ে তুলতে বৃক্ষরোপণ করছেন, পাঠচক্রে আন্দোলন আর শহীদদের সাহসিকতার গল্প নিয়ে আলাপ করছেন। স্বপ্ন বুনছেন আগামীর এক অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের, যেখানে শুধু বন্ধুত্বেরই জয়গান হবে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, আশা—বন্ধুদের এই জয়যাত্রা নিশ্চয়ই থামবে না।