সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী জামিলা। গরিব পরিবারে জন্ম। অভাব–অনটনের মধ্যেই বেড়ে ওঠা। অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকে, খুব বেশি চাহিদাও নেই তার। বাবার সাধ্যের বাইরে কোনো আবদার নেই। মা–বাবা যা দেবে, তা-ই খাবে; যা পরাবে, তা-ই পরবে। প্রতিদিন সকালে মায়ের সঙ্গে সংসারের টুকিটাকি কাজ করে তারপর স্কুলে যায়। মাঝেমধ্যে মা জামিলাকে ডিম বিক্রি করে এক–দুই টাকা দেয় খরচ করার জন্য। জামিলা তা খরচ না করে মাটির ব্যাংকে জমা রাখে। একদিন ব্যাংক ভেঙে দেখে, এক শ টাকা হয়েছে। জামিলার খুশি দেখে কে!
পাড়ার মেয়েরা প্রতিদিন সকালে কলসি দিয়ে নদী থেকে জল আনতে যায়, সংসারের কাজ করার জন্য। কিন্তু জামিলার কলস ছিল না। ছোট্ট পাতিলা দিয়ে কয়েকবার করে নিয়ে আসতে হয়। অভাব মানুষকে কতটা অসহায় করে তোলে, তা অভাব না থাকলে বোঝা যায় না। মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্ন যেদিন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়, সেদিন মনের আনন্দটা ভিন্ন রকম হয়।
জামিলার বহুদিনের স্বপ্ন, টাকা জমিয়ে মাটির কলস কিনবে আর তা দিয়ে সংসারের কাজ–কর্ম করবে। রোজ সকালে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে মাটির কলস নিয়ে নদীর ঘাটে যাবে, হাসি–আনন্দে জল আনবে। জামিলা এক শ টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘আমার জন্য একটা মাটির কলস আনবা।’
বাবা চিন্তা করতে লাগল, এই টাকা জামিলা কোথায় পেয়েছে। ‘আমরা তো কখনো জামিলার হাতে টাকা দিইনি। তাহলে কি সে অন্যায় করে কোথাও থেকে নিয়ে এসেছে?’ বাবার মনে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে দেখে জামিলা নিজেই বলতে শুরু করে, ‘শোনো বাবা, মাঝেমধ্যে মা আমাকে ক্লাসে টিফিন খাওয়ার জন্য দুই-এক টাকা দিত। আমি না খেয়ে সেগুলো জমাতাম।’
শুনে বাবা বলে, ‘সত্যি কইতাছো মা, আমি তোর হতভাগ্য বাবা! অভাবের কারণে কখনো তোর কোনো শখ–আল্লাদ পূরণ করতে পারি নাই। আমি কালকাই মাটির কলস নিয়া আসব।’ গরিবের স্বপ্ন মাটির কলস, তা-ই যেন সুখের উল্লাসে আবেগে আপ্লুত। পরদিন বাবার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আসে, বাজারে যাওয়ার মতো শক্তি নেই। অসুস্থতা দেখে জামিলা মাটির কলসের কথা ভুলে যায়। সময় এবং পরিস্থিতি এমন হয় যা আবেগ ও স্বপ্নের কাছে হার মানে। জামিলা মাটির কলস নিয়ে যে স্বপ্ন মনের মধ্যে লালন করে এসেছে, আজ তা অপূর্ণ হতে পারে না। অসুস্থ শরীর নিয়েই বাবা বাজারে গেল মাটির কলস আনার জন্য।
একদিকে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, শরীর কাঁপছে; তার মধ্যেও মেয়ের জন্য কলস নিয়ে বাড়িতে রওনা হলো বাবা। হঠাৎ হাত থেকে পড়ে মাটির কলস চূর্ণ–বিচূর্ণ হয়ে গেল! চোখে জল আর মলিন চেহারা নিয়ে বাবা বাড়ি ফিরে এল।
‘কী হয়েছে বাবা, তোমার চোখে জল কেন?’ ‘মা রে, তোর মাটির কলসের স্বপ্নটাও পূরণ করতে পারলাম না।’ জামিলার চোখে জল খেলা করে। ‘মা রে, কাঁদিস না। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল, শক্তি পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ হাত থেকে পড়ে কলসটি চূর্ণ–বিচূর্ণ হয়ে গেছে।’ ‘বাবা, আমি মাটির কলসের জন্য কাঁদছি না। আমি কাঁদছি তোমার কান্না দেখ। আমার চেয়ে তুমি বেশি কষ্ট পেয়েছ।’