ক্রিকেটবিলাসী হুমায়ূন আহমেদের কথা কি আমরা জানি? হয়তো জানি, হয়তো না।
জোছনাবিলাস, ভূতবিলাস, বৃষ্টিবিলাস—টার্মগুলো সামনে এলেই মুহূর্তেই যে নাম হৃদয়ে ভাসে, তিনি হলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। গাজীপুরে শখের নুহাশপল্লীতে রীতিমতো আসর করে তাঁর জোৎস্না কিংবা বৃষ্টি উপভোগের খবর প্রায় সবারই জানা। কিন্তু ক্রিকেটবিলাসী হুমায়ূন আহমেদের কথা কি আমরা জানি? হয়তো জানি, হয়তো না। জোৎস্নাভেজা মুগ্ধতায় তিনি লিখেছেন, ‘চাঁদনী পশরে কে আমারে স্মরণ করে/ কে আইসা দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে।’ আবার ঝমঝম বর্ষায় জীবনের আলোড়নে আবেগঘন সুরে লিখেছেন, ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো এক বরষায়।’ এসবের পাশাপাশি একেবারে কাঁচা জ্ঞান সত্ত্বেও ক্রিকেট নিয়েও এই লেখকের উচ্ছ্বাসের অন্ত ছিল না। ‘আজি এ বসন্তে’, ‘বাংলা ধোলাই: তেত্রিশটা কামান নিয়ে বসে আছি’, ‘ডাংগুলি’ ‘মাঠরঙ্গ’ শিরোনামে প্রকাশিত ফিচারগুলোয় হুমায়ূন আহমেদ নিজেই তাঁর ক্রিকেট–পাগলামির অসংখ্য ঘটনা বলে গেছেন।
২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চলমান সময়কে ‘বিশ্বকাপ ক্রিকেট বসন্ত’ আখ্যা দিয়ে ‘আজি এ বসন্ত’ শিরোনামের শুরুটাই হুমায়ূন আহমেদ করেছেন এভাবে-
‘অদ্ভুত এক বসন্ত এসেছে বাংলাদেশে। বসন্তের এই রূপ রবীন্দ্রনাথ জানতেন না। “বিশ্বকাপ ক্রিকেট বসন্ত” তাঁর সময়ে ছিল না। আচ্ছা ধরা যাক, তিনি এই সময়ে বাস করছেন, তাহলে কী করতেন? নিশ্চয়ই ক্রিকেট বোর্ড বিশেষ ভিআইপি এসি বক্সে তাঁকে মাঠে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করত। তিনি আধশোয়া হয়ে বসতেন আরাম কেদারায়। কবি নজরুল এসবের ধার ধারেন না। তিনি বসতেন গ্যালারিতে। বল আকাশপথে বাউন্ডারির বাইরে গেলে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতেন, ছক্কা! ছক্কা! বিশ্বকাপের থিম সং লেখার এবং তাতে সুর দেওয়ার দায়িত্ব কবি নজরুল আগ্রহ নিয়ে নিতেন বলে আমার ধারণা। “তোরা সব জয়ধ্বনি কর”–জাতীয় লাইনে সেই থিম সং-এ থাকত। জয়ধ্বনি করার জন্য আমরা প্রস্তুত।’
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বিজয়ে প্রাচীন রোমের কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ দেখে আনন্দে আধপাগল হওয়ার মতোই আত্মহারা হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। আবার কখনো জয় উদ্যাপনে তেত্রিশটা কামানের তোপধ্বনি দেওয়ার কথাও ভেবে রেখেছেন। একই সঙ্গে টেলিফিল্মের শুটিংয়ে সুইজারল্যান্ড গিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ওয়ানডে ম্যাচ দেখার দুঃসাধ্য সাধন করার স্মৃতিচারণাও বুঝিয়ে দেয়, আসলে তিনি কতটা ক্রিকেটপাগল ছিলেন। ক্রিকেট–সম্পর্কিত অনুভূতি বর্ণনায় বারবার উঠে আসে দৃঢ়চেতা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা। একবার তো মাঠে গিয়ে খেলার অবস্থা দেখে নিশ্চিত বাংলাদেশের পরাজয় ভেবে বের হয়ে চলে এসেছেন। স্ত্রী শাওন আহমেদকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরাজয় আমি এত মানুষের সঙ্গে দেখব না।’
সেবার বাংলাদেশ জিতেছিল। সেই অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন ‘মাঠরঙ্গ’ শিরোনামের একটি লেখায়।
‘পৃথিবীতে কবিদের একটা বড় অংশ ক্রিকেট পছন্দ করেন। কারণ, কবিদের কাজ হচ্ছে ছন্দ নিয়ে। ক্রিকেট ছন্দময় খেলা বলেই কবিদের পছন্দের খেলা।’
ক্রিকেট নিয়ে এই যে যাঁর এত মাতামাতি, ক্রিকেট সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান একেবারে তলানিতে। বিশ্বাস হয়? ‘ডাংগুলি’ শিরোনামে একটি লেখায় সে বিষয়েও দিয়েছেন অকপট স্বীকারোক্তি। ঘটনাটি এ রকম-
ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে একটি পত্রিকার একজন রিপোর্টার তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। তবে ক্রিকেট নিয়ে রিপোর্টারের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেননি হুমায়ূন আহমেদ। এভাবে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় সাংবাদিক কিছুটা বিরক্ত হন। একসময় তিনি এ প্রশ্ন ছুড়ে বসেন, ‘আপনি যে ক্রিকেটের কিছুই বোঝেন না, তা কি আমি লিখতে পারি?’ জবাবে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ‘অবশ্যই পারো।’
ক্রিকেটের কিছু না বুঝেও খেলাটার প্রতি হুমায়ূন আহমেদের প্রচুর আগ্রহ সেই সাংবাদিককে রহস্যের গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। অবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কিছু না বুঝেও ক্রিকেট কেন পছন্দ করেন, একটু ব্যাখ্যা করবেন?’
হুমায়ূন আহমেদ জবাবে বলেন, ‘কারণ, আমি গল্পকার। ক্রিকেটে এক ওভারে ছয়টি বল করা হয়। বল করামাত্র গল্প শুরু হয়। নানান সম্ভাবনার গল্প। ব্যাটসম্যানকে আউট করার সম্ভাবনা, ছক্কা মারার সম্ভাবনা, শূন্য পাওয়ার সম্ভাবনা। ছয়টা বল হলো ছয়টি সম্ভাবনা গল্পের সংকলন।’ তিনি আরও যুক্ত করেন, ‘পৃথিবীতে কবিদের একটা বড় অংশ ক্রিকেট পছন্দ করেন। কারণ, কবিদের কাজ হচ্ছে ছন্দ নিয়ে। ক্রিকেট ছন্দময় খেলা বলেই কবিদের পছন্দের খেলা।’
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে ‘ফাউন্টেনপেন’ নামে একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বলপেনের কালি ফুরিয়ে গেলে তা ব্যবহার অযোগ্য হয়, ফেলে দিতে হয়। কিন্তু ফাউন্টেনপেন যতবার ইচ্ছে কালি ভরিয়ে কাজ করা যায়।’
কী চমৎকার চিন্তা! এমন কতশত ভাবনা আর চমকপ্রদ সব ঘটনা যে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ঝুলিতে। একজন নন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাটক-চলচ্চিত্র পরিচালক, শিক্ষক, বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী—এত সবকিছুর ঊর্ধ্বে ক্রিকেট প্রেমে মজে গিয়ে প্রবল দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবোধ আমাদের চেনায় এক ব্যতিক্রমী হুমায়ূন আহমেদকে। তিনি ক্রিকেটবিলাসী হুমায়ূন আহমেদ।
রাজারহাট, কুড়িগ্রাম