নিষ্পাপ অন্তর নিয়ে মানবশিশু এই পৃথিবীতে আসে। পরিপূর্ণতায় একদিন ফুলের মতো সৌরভ ছড়ায়। শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সুস্থ ও সবলভাবে গড়ে তোলাসহ মেধার বিকাশে মা-বাবার থাকতে হয় দ্ব্যর্থহীন মুখ্য ভূমিকা। বাইরের পরিবেশ, সমবয়সী অন্যান্য শিশুর আচার-আচরণের প্রভাব এবং শিক্ষালয়ের পরিবেশও শিশুর মন ও মনন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের দুধের যেমন বিকল্প নেই, ঠিক তেমনি শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার শিক্ষা, সংস্কৃতি, নম্রতা, ভদ্রতা, জ্ঞান-প্রজ্ঞারও বিকল্প নেই। উপপাদ্যের জনক পিথাগোরাস বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দুটো শব্দ হচ্ছে ‘‘হ্যাঁ’’ ও ‘‘না’’। অথচ হ্যাঁ ও না বলতেই মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভাবতে হয়।’
যা-ই হোক, সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে মানুষের চিন্তাচেতনা, অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিস্থিতি, প্রযুক্তির উৎকর্ষসহ আরও অনেক কিছুই। এখন আর একার আয়ে অনেকের সংসারই চলে না। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও উপার্জনের তাগিদে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এতে করে অনেক ক্ষেত্রেই মা ও বাবা উভয়ের ব্যস্ততায় সন্তানের পরিপূর্ণ যত্নেও কিছুটা ভাটা পড়ছে। আগে বেশির ভাগ পরিবারে একমাত্র পুরুষই ছিলেন উপার্জনকারী। মায়েরা তখন সন্তান লালন-পালনে যথেষ্ট সময় পেতেন। এখন দিন বদলেছে। অসংখ্য পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী। পরিবারের ছোট্ট শিশুকে বাসার কাজে সহায়তাকারী অথবা আত্মীয়স্বজনের কাছে রেখে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন। এতে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অনেকটা ঘাটতি নিয়েই বড় হতে হয়।
শহর ও নগরে আগের মতো মাঠঘাটও নেই। মাঠে গিয়ে খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ মাঠ ও খোলা জায়গা দখল করে সেখানে মানুষের বাসস্থান ও ব্যবসার প্রয়োজনে বড় বড় ইমারত গড়ে তোলা হচ্ছে। বউচি, এক্কাদোক্কা, গোল্লাছুটের মতো নানা ধরনের খেলাও আগে মেয়েরা স্কুলের মাঠে, মহল্লার মাঠে, এমনকি বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় খেলত। বর্তমানে শহরের বেশির ভাগ স্কুলে খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ থাকলেও ছোট শিশুদের নিয়ে খেলার মতো সময় ও ব্যবস্থা খুব একটা দেখা যায় না। শহরে আগে বাড়ির আশপাশে পুকুর ও নদী-নালা ছিল। শিশুরা ছোট থেকেই পুকুর-নদীতে সাঁতার কেটে নীরোগ শরীর নিয়ে বড় হতো। এখন আর শহরে তেমন নদী-নালা, পুকুর-ডোবা নেই। নদী-নালা প্রায় শুকিয়ে গেছে অথবা ব্যক্তিমালিকানাধীনে বা দখলদারত্বে বাড়িঘর উঠেছে সেখানে।
আগে খাবারের মানও ছিল ভালো। বাজার কিংবা আশপাশে পাওয়া যেত অর্গানিক টাটকা শাকসবজি; যা শিশুদের পুষ্টি-সহায়তায় ছিল দারুণ কার্যকরী। আর এখন জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় হাইব্রিড উৎপাদনে মানুষের মনোযোগ বেশি। উৎপাদনে ক্ষতিকর ওষুধও প্রয়োগ করা হয়। বেশির ভাগ ফলমূল এখন ফরমালিনযুক্ত। তাই আজকাল খাবারের গুণগত মান আগের মতো নেই। এসব খাবার গ্রহণে শিশুদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তবে স্থানীয় সরকারের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে।
মা-বাবার ব্যস্ততা, খাদ্যের গুণগত মান, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং খেলার অপ্রতুল ব্যবস্থার কারণে চারদেয়ালের মধ্যে একা একা বড় হচ্ছে শিশুরা। একাকিত্ব কাটাতে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে মুঠোফোন গেমসে। অভিভাবকেরাও ভাবছে, মুঠোফোনে গেমস খেলতে দিলে তাদের বাবুটা তাড়াতাড়ি খায়, নিজেরা ব্যস্ত থাকলে বাবুটা গেম খেলে একা একা সময় কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি। একনাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ গেমস খেলার কারণে শিশুদের চোখ ও নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্তসহ খাবারে অরুচি, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সখ্য কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, পড়াশোনা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নানা ধরনের সমস্যায় ভুগতে থাকে। তাই শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য একটু বেশি যত্ন নিতে হবে। পাশাপাশি ক্ষতিকর মুঠোফোন গেমসে যেন আসক্ত না হয়ে পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি।
হাজারীবাগ, ঢাকা