ছাতিম ফুলের সন্ধ্যে

ছাতিম ফুল, প্রতীকীছবি: সংগৃহীত

শরতের আকাশে হালকা হিমের পরশ যুক্ত হয়েছে। সুয্যি মামা একটু তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে শুরু করেছে। ছাতিম ফুলের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছে হেমন্তের আগমন। ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাস যেন হেমন্তের গায়েরই ঘ্রাণ!

প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে গিয়েছিলাম সবুজে বেষ্টিত পাহাড়ি অঞ্চল রামু উপজেলার খুনিয়া পালংয়ে। শহীদ এ টি এম জাফর আলম মাল্টিডিসিপ্লিন একাডেমি ছিল মূল পয়েন্ট। ওখানকার ভারপ্রাপ্ত সুপারইন্টেডের সঙ্গে সখ্যর খাতিরে যাওয়া। বিশাল এলাকাজুড়ে সবুজের কী এক সম্মোহনী উপস্থিতি। তার ঠিক মাঝখানে পদ্মফুলের মতো যেন ভবনগুলো। জ্ঞানের সুবিস্তৃত নিপুণ সারির কারিকুলাম প্রতিষ্ঠানটির। অমন বন্ধুর জায়গায় এত সুন্দর আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়। পুরো দিনটা দারুণ কাটল প্রকৃতির সঙ্গে মাখামাখি জড়িয়ে। আমাকে সঙ্গ দিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী সারাক্ষণ ছিল। খুব মিষ্টি আর সরল বাচনভঙ্গী তাদের। নবম শ্রেণিতে পড়া মেয়েদের সুন্দর আতিথেয়তা আমাকে অবাক করেছে।

পাখিদের কিচিরমিচির জানান দিচ্ছে, ঘরে ফেরার সময় হয়েছে। কিন্তু মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। অগত্যা নিরুপায় হয়ে হাঁটা ধরি। মাঠ পার হতেই এক মাতাল করা ঘ্রাণ নাকে এল। খুব পরিচিত আর প্রিয় ঘ্রাণ। দীর্ঘ এক বছর আগে এই সুবাস প্রাণভরে নিয়েছিলাম।

এখানে এই সময় প্রিয় এই ঘ্রাণ পাব, কল্পনায়ও ছিল না। একটু সামনে এগোতেই ছাতিমগাছটা স্পষ্ট হলো। বাতাসে ভেসে আসা সুবাসে গাছটিকে খুঁজে নেওয়া খুব সহজ। থোকা থোকা ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ খোলা দিগন্তে যেন লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে। সুন্দর দিনটার ক্ষাণিক অপূর্ণতা হয়তো প্রকৃতি বুঝেছিল। তাই বাকি পূর্ণতা দিতে কার্পণ্য করেনি এতটুকুও!

আমার উচ্ছ্বাসে বিস্মিত হয়ে মেয়েগুলো জানতে চাইল ফুলটি সম্পর্কে। আমিও দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের ছাতিম ফুলের বর্ণনা করতে বসে যাই মাঠের এক প্রান্তে। যেখানে গোধূলির লাল আভা আর ছাতিম ফুলের মহোময়ী মিষ্টি সুবাস শান্ত পরিবেশটাকে করে তোলে অপ্সরীর মতো।

পথতরু হিসেবে ছাতিম দারুণ উপকারী। এর বেড়ে উঠতে বেশি সময় লাগে না। ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা সরু পত্রবিন্যাসে আশ্রয় মেলে পথিকের। একই মূলাবর্তে চার থেকে সাতটি পর্যন্ত পাতা থাকে। বছরের এ সময়ে সারা গাছ ভরে গুচ্ছবদ্ধ, তীব্র গন্ধী, হালকা ঘিয়ে রঙের ছোট ছোট এই ফুল। এই গাছ ৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। বহুশাখাবিশিষ্ট গাছটির ছাল গন্ধহীন, অসমতল ও ধূসর। ছাতিমপাতার ওপরের দিক চকচকে আর তলার দিক ধূসর থাকে। শরতের শেষের দিকে এই ফুল ফুটতে দেখা যায়। হেমন্তকাল আসতেই কড়া নাড়ে যেন এগুলো।

হেমন্তের সন্ধ্যাকে অপূর্ণ মনে হয় ছাতিম ফুল ছাড়া। ফলশূন্য প্রকৃতিকে পূর্ণতা দেয় ছাতিম ফুল। গাছজুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ হালকা ঘিয়ে রঙের ফুল। মনে হয় যেন, কেউ অসংখ্য ফুলের স্তবক তৈরি করে রেখেছে। ছাতিম ফুলের মাদুলি গাঁথা আঁচ থেকে ঝরে পড়া শিশিরাদ্র বায়ুকে করে তুলেছে চঞ্চল। মধ্যরাতে বাঁশবনের মাথার ওপরে চাঁদের ম্লান জ্যোৎস্না শিশিরসিক্ত করে দেয় চারপাশ, তারই চক্করে আপ্লুত হয়ে তীব্র গন্ধ ছাড়ে ছাতিম ফুল। এর মাদকতাঘেরা গন্ধ যেন আবিষ্ট করে দেয় অনুভূতিদের। রাত যত বাড়বে, ঘ্রাণ ততই তীব্র হবে। সকাল হতে হতে এই ঘ্রাণ আর থাকে না।
কেন ম্যাম? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল নাদিয়া।
এ হলো প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেলা! রাতে যে ফুলের এত ঘ্রাণ, সকালেই তা কী করে কর্পূরের মতো উবে যায়। আবার রাত শেষে বাসি ফুল থেকে ভেসে আসে এক ঝাঁজালো গন্ধ।

আচ্ছা কোনো গাছে এত ফুল ফুটতে দেখেছ তোমরা? পৃথিবীতে খুব কম গাছেই একসঙ্গে এত ফুল ফোটে! জানো, একসময় এই গাছ দিয়ে কফিন বানানো হতো। পেনসিল, ব্ল্যাকবোর্ডও বানানো হয় এই গাছ দিয়ে। পরিবেশের জন্যও বেশ উপকারী ছাতিমগাছ। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে ছাতিমের ব্যবহার বহুদিনের। এই গাছের ছাল, বাকলসহ নানা অংশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে ঔষধি হিসেবে।
কী কী ওষুধ বানানো যায়?
অনেক রকম। যেমন ধরো, দাঁতের মাড়ি ফুলে গেলে বা রক্ত পড়লে এর আঠা গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে কুলি করলে বেশ আরাম পাওয়া যায়। আমার দাদি এই গাছের ছাল দিয়ে কুষ্ঠ রোগীদের ওষুধ বানিয়ে দিতেন। এ ছাড়া আরও কত রকম ওষুধে ব্যবহৃত হয়।

তবে এই গাছের, তথা ফুলের তীব্র ঘ্রাণের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে বলে জানিয়েছেন অনেকে। ছাতিম ফুলের রেণু থেকে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই গাছ থেকে নিঃসৃত রজনজাতীয় সাদা রস থেকেও সংক্রমণ হতে পারে।
এই গাছ আর ফুল তোমাদের কেমন লেগেছে বলো?
দারুণ!
চলো, সবাই বাসায় একটি করে ফুলের ডাল নিয়ে যাই। সারা রাত ছাতিমের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকব। রবি ঠাকুর তাঁর প্রিয় ছাতিম নিয়ে কী লিখেছিলেন জানো? ‘ওই যে ছাতিমগাছের মতোই আছি/ সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি...’। সত্যি, আজ যেন মাটির কাছাকাছিই আছি।

বন্ধু, কক্সবাজার বন্ধুসভা