রেবেকা ম্যাডাম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
সেই পুরোনো গন্ধ, পুরোনো মায়া, পুরোনো মমতাময়ী নারী। চোখের সামনে ভেসে ওঠল ২০ বছর আগের চিত্র।

রেলস্টেশনে বসে আছি। পাশে এসে বসলেন এক বয়স্কা। গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারাজুড়ে কষ্টের ছাপ। অতি সাধারণ পোশাক, মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পুরোনো কালের শৌখিন ব্যাগ। চেহারাটা কেমন পরিচিত লাগছিল।

রেবেকা ম্যাডাম! আমার সমস্ত সত্তা যেন নড়েচড়ে ওঠল। আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাডাম। ওনার হাঁটুর কাছে বসলাম। ‘কে তুমি মা?’
‘ম্যাডাম, আমি সুজনা। আপনার সেই সুজনা, যাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলেন।’
ম্যাডাম মুখ দিয়ে কিছুই বললেন না। শুধু আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে আলতো হাত রেখে দিলেন। সেই পুরোনো গন্ধ, পুরোনো মায়া, পুরোনো মমতাময়ী নারী। চোখের সামনে ভেসে ওঠল ২০ বছর আগের চিত্র।

তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। সদ্য মাকে হারিয়েছি। বাবা আমাকে মাঝেমধ্যে ম্যাডামদের বাসায় নিয়ে যেতেন। একদিন ম্যাডাম বললেন, ‘সুজনাকে আমার কাছে রেখে যা রহিম। ওর পড়ালেখায় অনেক ঘাটতি আছে। এখানে থাকলে পড়ালেখা ঠিকমতো হবে। তুই তো প্রতিদিন আসবিই। তা ছাড়া আমিও একা থাকি।’

ম্যাডামের এক ছেলে, বউ-বাচ্চা নিয়ে বিদেশে থাকে।  তখন থেকে বাবা আমাকে ওখানে রেখে দেন। বাবার জন্য ভালোই হলো, আমাকে নিয়ে বাড়তি টেনশন করতে হতো না। আমি ওনার স্কুলেই পড়তাম। শিক্ষার নতুন করে হাতেখড়ি হলো। তখন থেকে আমার সব খরচ উনি চালাতেন। পঞ্চম শ্রেণি শেষ হলে তিনি আমাকে নিয়ে এলেন শহরের স্কুলে। হোস্টেলে ভর্তি করে দিলেন। নিজের তত্ত্বাবধানে সব ঠিকঠাক করে চলে গেলেন গ্রামে। বছরে যে কয়বার স্কুল ছুটি হতো, ওনার কাছেই থাকতাম। দেখতে দেখতে মাধ্যমিক শেষ হলো। অনেক কিছু বুঝতে শিখলাম। বাবা গত হলেন। ম্যাডামের কাছে এসে জানতে পারলাম, উনি বিদেশে ছেলের কাছে চলে যাচ্ছেন। আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘তুইও দূরে থাকিস, তোর বাবাও নেই। ভালো লাগে না। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। একা জীবনে চাকরি-বাকরি দিয়ে কী হবে? ছেলের কাছে গিয়ে নাতি-নাতনীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে মরতে চাই।’
‘ম্যাডাম আমার তো মাধ্যমিক শেষ। এখন থেকে তোমার কাছেই থাকব। তোমার দেখাশোনা করব। তুমি কোথাও যেয়ো না প্লিজ।’ ‘তা কী করে হয়রে সুজনা? তোর ভবিষ্যৎ আমার জন্য এই পাড়াগাঁয়ে নষ্ট হোক, চাই না। রেজাল্ট প্রকাশ হলে তোকে ভর্তি করিয়ে দিয়েই আমি দেশের বাইরে যাব।’

অনেক বোঝানোর পরও কিছু হলো না। দুই বছরের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করে প্রাচ্যের দেশে পাড়ি জমালেন। কথা ছিল দুই বছরের মধ্যে দেশে ফিরবেন।

দেখতে দেখতে অনেক বছর কেটে গেলেও ম্যাডামের আর খোঁজ পাইনি। এইচএসসি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। টিউশনি আর বৃত্তির টাকায় ভালোই চলে যেত। পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেতে বেশি সময় লাগল না।

প্রতিবছর শিক্ষক দিবসে ওনার কাছে চিঠি লিখতাম, গ্রামে ছুটে যেতাম। কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি।

আমার জীবনের সেরা শিক্ষককে আজ আমি খুঁজে পেয়েছি। যাঁর অবদান না থাকলে আমার জীবন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো কবেই চুপসে যেত।

ঈদগড়, রামু, কক্সবাজার