লড়াইয়ের ময়দানে মন্ত্রের মতো ছবি ‘ন ডরাই’

‘ন ডরাই’ চলচ্চিত্রে সুনেরাহ বিনতে কামালসংগৃহীত

চলচ্চিত্রের নামকরণের মধ্যেই একটা জাগরণের মন্ত্র লুকিয়ে আছে। আমার চাটগাঁইয়া মা বলতেন, ‘অ পুত, যে মাডিত আছাড় খাবি, হেই মাডিত থিয়া হই দাঁড়ান পরিবু।’ উদ্বাস্তুজীবনে ভীষণ লড়াইয়ে চলার পথে এই কথাটা বারবার পথ দেখিয়েছে। জীবনের যত প্রতিকূলতা, পথের শেষে পথের বাঁকে অন্তিম পথ, তবু অন্ত বলে কিছু নেই। প্রতিটি অন্ত থেকেই অনন্তের পথে নিরন্তর যাত্রা শুরু হয়। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ, ঘোর ঘনঘটা, বারবার হেরে যাওয়ার পরও লড়াইয়ের ময়দান না ছাড়া। বুকের ভেতর সাহস আর অকুতোভয় মনোভাব—তারই মূলমন্ত্র, মূল ভাষা তো ‘ন ডরাই’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতায় মাটি-মানুষের সংস্কৃতির জয়ধ্বজা উড়িয়ে তেমনই একটি বিশ্বজনীন জীবন-দর্শনের কথা তুলে আনলেন তরুণ পরিচালক তানিম রহমান অংশু তাঁর চলচ্চিত্রে। কাহিনি দাঁড় করিয়েছেন শ্যামল সেনগুপ্ত আর চিত্রনাট্য বুনেছেন মাহবুব রহমান রুহেল।

আপামর ছন্নছাড়া বাঙালি কাদামাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে পায়ে-পায়ে ডাবের খোল নিয়ে ছুটতে ছুটতে যেভাবে ফুটবল খেলতে শিখেছে, নরম কোমল চরণযুগল লোহার মতো শক্ত হয়ে যাওয়ার পড়ে পায়ে বুট জুতা উঠেছে। গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে ডাংগুলি খেলতে খেলতে বিদেশিদের কাছে দেখা ক্রিকেট খেলতে শিখেছে। শেষ পর্যন্ত সেই খেলাটা অবশ্য ফুটবলের মতো বাঙালির খেলাও হয়ে গেছে। খেলার মাঠে বাঙালি সন্তানেরা বিশ্বজয় করেছে। পুকুর-ডোবায়, নদী-সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে বঙ্গসন্তানেরা এমনিতেই আজন্মকালের সাঁতারু। ঘূর্ণিঝড়ে-বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে মরতেও কলাগাছের ভেলা বেঁধে ভেসে থেকেছে। সেই বাঙালি জীবনে ‘সার্ফিং’ শব্দটাই শুধু বিদেশি। সমুদ্রের ঢেউয়ের বুকে জীবন বাজি রেখে ভেসে চলার খেলাটা নতুনতর কিছু নয়। আবার চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতা মানেই কিন্তু কুয়োর ব্যাঙ নয়। মুখের ভাষা এবং সংস্কৃতিতে আঞ্চলিকতা থাকলেও এই চাটগাঁইয়ারা বরাবরই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন। সেভাবেই কক্সবাজারের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষেরা জড়িয়ে গেছেন সার্ফিংয়ের সঙ্গে। ন ডরাই চলচ্চিত্রে পরিচালক এই জীবন-মরণ ভেসে থাকার, ভালোবেসে থাকার খেলাটাকে একেবারে বিশ্বজনীন ডিসকভারি চ্যানেলে দৃশ্যগ্রাহ্য পরিবেশন-উপস্থাপনের মতো করে তুলে এনেছেন।

চলচ্চিত্রে প্রতিটি দৃশ্য, সেট নির্মাণ, শিল্পনির্দেশনা, ক্যামেরার ভাষা থেকে পোশাক পরিকল্পনা সবকিছুই অনবদ্য। এমন সুন্দর চলচ্চিত্রায়ণ আঞ্চলিক সংলাপ এবং গল্পের কাহিনিকেও বিশ্বজনীন করে তুলতে সাহায্য করেছে। যাঁরা চাটগাঁইয়া ভাষা বুঝবেন না, তাঁদেরও গল্পের মূল সুর ধরিয়ে দিতে বারবার কিছু বিদেশি, ইংরেজিতে কথা বলা চরিত্র এসেছে। মূল সার্ফিং প্রশিক্ষক আমির ভাইয়ের বউ বিদেশিনী। চাটগাঁইয়া পোয়ার বিদেশিনী বউ—এই বিষয়গুলোও ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রাম শহরে দেখে এসেছি। কক্সবাজার গোটা বাংলাদেশের একটা বড় পর্যটনকেন্দ্র হওয়ায় বিদেশিদের আনাগোনা এখানে লেগেই থাকে।

চট্টগ্রাম শহরে শৈশবকাল অতিবাহিত করা সত্ত্বেও কখনো কক্সবাজার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে মামাবাড়ি বাঁশখালী যাওয়ার সময় দেখতাম সেই রাস্তা দিয়েই সবাই কক্সবাজার যাচ্ছে। বাবা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে বছরে এক-দুবার কক্সবাজার যেতেন। ঝিনুকের পুতুল, ঘর সাজানোর ঝিনুকঝুরি, পুঁতির মালা, কুলের আচার, বড় তোয়ালে এসব কিনে আনতেন। ফলে না দেখা সমুদ্রসৈকতও আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। পতেঙ্গা সৈকতে আমরা অবশ্য বহুবার গেছি। একবার বাবা কক্সবাজার থেকে ফিরে এসে তোলা ছবি প্রিন্ট করে এনে দেখালেন। দেখে অবাক হয়ে গেছি বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আব্বাস উদ্দীনের পুত্র মুস্তাফা জামান আব্বাসীর পাশে দাঁড়িয়ে দল বেঁধে সবাই ছবি তুলেছেন। ‘ও আমার দরদি আগে জানলে, আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না…’ মুস্তাফা জামান আব্বাসীর কণ্ঠে গানটি মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখানো হতো। ফলে তিনি আমাদের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। তা ছাড়া বিটিভিতে ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানে ফেরদৌসী রহমানের কাছে গান শিখতে আমরা টিভি খুলে বসে যেতাম। তত দিনে জানতে পেরেছি তিনিও আব্বাস উদ্দীনের কন্যা। ন ডরাই চলচ্চিত্রটি যে নারীর জীবনসংগ্রামের কাহিনিকে তুলে ধরে, এখানে সেই আয়েশাও সমুদ্রসৈকতে ঝিনুকের অলংকার বিক্রি করে। তার হাতে গড়া অলংকারের চাহিদা আছে। বাবা-মা ও ভাইয়ের সংসারে পেট চালানোর জন্য সে এই কাজ করলেও তার জীবনের মূল ধ্যানজ্ঞান-স্বপ্ন সবকিছুই সার্ফিং।

‘ন ডরাই’ চলচ্চিত্র

কিন্তু সে যে একজন নারী! একজন পুরুষ যা কিছু করতে পারে, সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় একজন নারী তা পারে না। মা তাকে শাসন করে বলে, ‘এই সব সার্ফিং-টার্ফিং বাদ দে। ঘরের মাইয়াপোয়া সমুদ্রের বুকে গিয়ে ভেসে বেড়ালে, বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে মিশলে তার বিয়ে হবে না।’

আয়েশার দাদা লিয়াকত বিদেশে যাওয়ার সার্ফিং প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে গিয়ে সুযোগ পায় না। বোন যাতে কোনো অবস্থাতেই সার্ফিং না করে, ঘরে ঢুকে জুতা দিয়ে, লাঠি দিয়ে উন্মাদের মতো পেটায়। একজন শুঁটকি ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে আয়েশার বিয়ে ঠিক করা হয়। শ্বশুরবাড়িতে এই কন্যাকে দাসী-বাঁদির মতো করে খাটায়। স্বামী জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। বেধড়ক পেটায়। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক রাতে আয়েশা স্বামীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। গর্জন করে বলে ওঠে, ‘আঁই সাগররে ন ডরাই মাইয়াপোয়া, তোর মতো হারামজাদারে ডরাইয়ুম না…।’ এখানেই চলচ্চিত্রের মূল বার্তা ঘোষিত হয়।

স্বামীর জেলখানা থেকে আয়েশার মুক্তি মেলে। আয়েশাকে পাগলের মতো ভালোবাসে সোহেল। আমির ভাই তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে পুরস্কার জিতিয়ে আনে। কিন্তু একসময় সার্ফিং ভুলে গিয়ে সেও অন্য নেশায় ডুবে যায়। ভাসতে ভাসতে আয়েশার জীবন আমির ভাইয়ের বাড়িতে এসে ঠাঁই পায়। সোহেলকেও মুক্ত করে নিয়ে আসে তার বন্ধু। হারানো দুটি প্রেমিক-প্রেমিকা, জীবনপোড়া বিধ্বস্ত দুই প্রেমিক-প্রেমিকা, ডুবন্ত দুটি প্রাণ সার্ফিংকে অবলম্বন করে আবার ভেসে ওঠার চেষ্টা করে। তাদের মিলনমুহূর্তগুলোর দৃশ্যায়ন অতীব সুন্দর। ছবির গানগুলোও ভালো। তবে চাটগাঁইয়া ভাষার গান ব্যবহার করা যেত। আর আয়েশা যে নতুন করে সার্ফিং প্রশিক্ষণ নিয়ে একটা পুরস্কার জয় করার জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে বা পুরস্কার পাচ্ছে, তেমন একটা দৃশ্য পর্যন্ত ছবি বর্ধিত করা যেত। আয়েশা বা সোহেল প্রেমের সাগরে ভেসে যাওয়ার জন্য ওদের জীবন নয়। জীবনে প্রেম দরকার, তার থেকেও বড় প্রেমের সাধনা তাদের সার্ফিং। এ ক্ষেত্রে তো প্রশ্ন থেকেই যায়, সোহেলের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে বা সোহেলকে সামনে এগিয়ে দিতে গিয়ে বরাবরের মতো সে আবার জীবনের স্বপ্ন নিবেদন করে বসবে না তো? নারীর জীবনমাত্রই যে আত্মত্যাগের জন্য।

আয়েশা চরিত্র যেমনটা হওয়া প্রয়োজন, সুনেরাহ বিনতে কামাল একেবারে তেমনই। তাঁর অভিনয়ে একজন দক্ষ শিল্পী যোদ্ধার পরিচয় ফুটে ওঠে। ভবিষ্যতে অনেক দূর যাবেন এই অভিনেত্রী। সোহেল চরিত্রে শরীফুল রাজ অনবদ্য। প্রশিক্ষক আমির মানে সাঈদ বাবু অনন্য। সোহেলের মাতাল বাবা হিন্দোল রায় জমিয়ে দেন। গোটা চলচ্চিত্রজুড়ে ছয় অক্ষরের চাটগাঁইয়া গালাগালি ফুলঝুরির মতো ছোটে। কে কাকে এই গালাগালি দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে অতশত মাথায় রাখে না। এটা আসলে চাটগাঁইয়া ভাষার টান। তীব্র রাগ, হাতাহাতি থেকে মারামারি, এই গালাগালি যেন রাগ কমানোর টনিক। শুঁটকি ব্যবসায়ী চরিত্রে নাসির উদ্দিন খানও একেবারে খাঁটি চাটগাঁইয়া অভিনেতা। অন্য অনেককে অভিনয়ের জন্য ভাষাটা শিখতে হয়েছে। আবার কারও কারও রক্তে মিশে রয়েছে এই ভাষা আর সংস্কৃতি। বিদেশি অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও চমৎকার অভিনয় করেছেন। বাঙালি আর অবাঙালিদের মিলমিশে এমন ছবি বারবার হওয়া দরকার। সব দিক থেকেই ন ডরাই একটা ভয় না পাওয়া সফল ছবি।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত