কালের সাক্ষী পটিয়ার শতবর্ষী মুহাম্মদ আলী মুন্সী জামে মসজিদ

মুহাম্মদ আলী মুন্সী জামে মসজিদছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা পরিষদের দক্ষিণে পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের এস আলম গেট হয়ে এক কিলোমিটার দূরে আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে একটু সামনে গেলে চোখে পড়বে সরু খালের ওপর কালভার্ট, ধীরগতিতে চলে গেছে বাঁকে বাঁকে। মাঝেমধ্যে পুকুর, ধানের জমি। ধানের জমিতে এখন আর চাষাবাদ হয় না। কালের বিবর্তনে জমি ভরাট হয়ে দালান দাঁড়িয়েছে, বাইপাস সড়ক, আবাসিক এলাকা—অনেকটা শহরের ছোঁয়া লেগেছে। চারদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো দালান আর দালান।

শীত মৌসুমে ধান কাটার পর নাড়া জ্বালিয়ে শীত নিবারণের বৃথা চেষ্টা, চড়ুইভাতি, পাড়ার ছেলেরা মিলে জমিতে ক্রিকেট পিচ করে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম—ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর এখন সোনালি অতীত। লালমিয়া গান্ধী স্মৃতি ক্রিকেট ক্লাব ও নেজাম স্মৃতি ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যরা মাতিয়ে রাখতেন খেলার মাঠ। আহমেদ সওদাগরের কবরস্থানের ২০০ বছরের পুরোনো রেইন ট্রি, পাশে সোনালু ফুল গাছের সারি। গ্রীষ্মকাল এলে সোনালু ফুলের গাছগুলো হয়ে যেত হলুদ শাড়ি পরা নতুন বধূ। বাতাসে সোনালু ফুলগুলো কানের দুলের মতো দুলত। রেইন ট্রি দেখলে মনে হবে বৃক্ষ নয়, যেন ফুলকপি।

রাস্তার পাশে সিদ্দিকিয়া মঞ্জিল বাড়ির ফটক। কালের সাক্ষী ঐতিহ্য বহন করে আসছে এই পুরোনো বাড়ি। দুই প্রজন্মের দুই সাবরেজিস্ট্রারের জন্ম এই বাড়িতে। প্রয়াত সিদ্দিক সাবরেজিস্ট্রার ও প্রয়াত মোশারফ আলী সাবরেজিস্ট্রার। সাবরেজিস্ট্রার থেকে সাবরেজিস্ট্রার বাড়ি। একটু সামনে প্রাচীন বটবৃক্ষ। পুকুরের দক্ষিণে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে সুদর্শন প্রাচীন মসজিদ। পুকুরপাড়ে প্রাচীন বটগাছ। গাছের নিচে ছেলেবেলায় বসে বসে দাবা, লুডু, মার্বেল, ডাংগুলি, চারাসহ কত না খেলা খেলেছি। স্কুল পালিয়ে বটতলায় এসে মার্বেল খেলতাম। বটগাছের শুকনো পাতা নিয়ে দাদুকে দিতাম হুঁকো টানার জন্য। অনেকে বটগাছের পাতা দিয়ে বিড়িও তৈরি করত। বটতলা এখন আর নেই। কাঁটা তার দিয়ে ঘেরাও করে দেওয়া হয়েছে। পুকুরপাড়ে প্রায় ১০০ একরের বেশি জায়গাজুড়ে ১৮২৩ সালে নির্মিত হয় মুহাম্মদ আলী মুন্সী জামে মসজিদ। প্রথম দিকে মাটির নির্মিত ইবাদতখানা ছিল। পরে বেড়া দিয়ে নির্মিত হয়। ধারণা করা হয়, ১৭৮৫ সালের দিকে এটি প্রথম নির্মিত হয়। পরে এমদাদুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশ (খান কোম্পানি) মসজিদটি ১৯৬৫ সালে সংস্কার করেন। সংস্কারের কাজে এগিয়ে আসেন প্রকোশলী ও ঠিকাদার বাবুল, মাহাবুবুর রহমান, পটিয়ার সংসদ সদস্য মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীসহ অনেকে।

২০১০ সালে হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা আহসান উল্লা শিবলুর সহযোগিতায় মসজিদে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। এরপর থেকে নিয়মিত কোরআন শিক্ষা ও ইসলামিক পাঠাগার কার্যক্রম চলছে। মসজিদে এলাকার কোরআনের পাখি ফুলের মতো শিশুরা আরবি পাঠ নিয়ে থাকেন।

১৭০০ সালের দিকে মুহাম্মদ আলী মুন্সীর পূর্বপুরুষ আরব থেকে এসেছেন। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ জীবন। সে সময় তাঁদের স্থায়ী বসবাস ছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার ছিপাতলী গ্রামে। তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে চাকরির সুবাদে পটিয়া সিভিল কোর্টের উকিল (ফারসি শব্দ মুন্সী) হিসেবে যোগদান করেন মুহাম্মদ আলী মুন্সী। একসময় তিনি পটিয়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নজু মিয়া দারোগা বাড়িতে (পুরোনো বাড়ি) স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সে সময় এক বড়ুয়ার কাছ থেকে পরিত্যক্ত ভিটা (বর্তমান সাবরেজিস্ট্রার বাড়ি এলাকা) কিনে নেন। প্রথম দিকে ইবাদতখানা নির্মাণ করা হয়।

মুহাম্মদ আলী মুন্সী উকিল পেশা ছাড়াও ছিলেন একজন সুফিসাধক ও আধ্যাত্মিক পুরুষ। কর্মজীবনের পাশাপাশি বেশির ভাগ সময় ইবাদত–বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। এলাকায় তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও বড় বাজি নামে পরিচিত। সুফি সাধক মুহাম্মদ আলী মুন্সীর চার পুত্র। প্রথম পুত্র মোশারফ আলী এবং দৌহিত্র সিদ্দিক আহমদ (মোশারফ আলী সাবরেজিস্ট্রারের পুত্র) দুজনই দুই প্রজন্মের সাবরেজিস্ট্রার ছিলেন। সমগ্র পটিয়ায় শিক্ষাদীক্ষায় এ বাড়ির বেশ সুনাম রয়েছে। এ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছেন পটিয়ার বর্তমান সংসদ সদস্য মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, তৎকালীন রাজস্ব ও নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদুন নবী, ল্যান্ড ইন্সপেক্টর, ডিসি অফিসের হিসাবরক্ষক ফোরক আহমেদ চৌধুরী, কবি আবু তাহের খান, নাট্যকার প্রয়াত চৌধুরী মোহাম্মদ হাশেম, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক ফারুক মোহাম্মদ সিদ্দিকি, কুমিল্লা বার্ডের যুগ্ম পরিচালক নেওয়াজ আহমদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক জাহিদুল আলম, লেখক ও সাংবাদিক হানিফ মুহাম্মদ সিদ্দিকি (আমেরিকাপ্রবাসী), বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীসহ আরও অনেক কৃতী মুখ।

স্থানীয় অনেকে মোহাম্মাদ আলী মুন্সীর সুহবতে বা সান্নিধ্য লাভ করে ব্যবসায় ও চাকরিতে সফল হয়েছেন। মসজিদের পাশে মোহাম্মদ আলী মুন্সীর (র.) রওজা শরিফ। মসজিদের পাশে শিউলি, চাঁপা, কাঠবাদাম, শিমুলগাছসহ নানা রকমের ফুলের বাগান রয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো শিল্পির তুলির আঁচড়ে গড়া শৈল্পিক এক নান্দনিক মসজিদ। মসজিদের ভেতরে মিম্বারের দেয়ালে প্রাচীন শিল্পীদের কারুকাজ রয়েছে। মসজিদটির পুকুরে পানির মধ্যে গাছ আর মসজিদের জলছবি যেন জলতরঙ্গের সঙ্গে খেলা করে। দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি দেখলে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে। প্রাচীন মসজিদ নিয়ে পটিয়ার সংসদ বীর মু্ক্তিযোদ্ধা মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের নির্মিত প্রায় দুই শ বছরের আদিকালের মসজিদটি ঐতিহ্য বহন করে আসছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে আদিকালের মসজিদের মধ্যে মুহাম্মাদ আলী মুন্সী জামে মসজিদটি সুন্দর শৈল্পিক এবং দৃষ্টিনন্দনও বটে।  ভবিষ্যতে মসজিদটি আরও নান্দনিকভাবে স্থাপন করার পরিকল্পনা আছে।’ পটিয়া সদরে শতবর্ষী মসজিদটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা