সুবর্ণাই যেন গহীন বালুচর

গহীন বালুচর ছবিতে সুবর্ণা মুস্তাফা

বদরুল আনাম সৌদ বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবী পরিচালক। ছবির গল্প বোনা থেকে শুরু করে নির্দেশনা—সবকিছুতেই দক্ষ কারিগর তিনি। তাঁর পরিচালনায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘খণ্ডগল্প ১৯৭১’ দেখেছি কলকাতার নন্দনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে। এই চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের কালজয়ী শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফাকে দেখেছি একেবারে ভিন্ন রূপে।

তখন থেকে মনে হতে শুরু হয়েছিল, বাংলাদেশের দুই অভিনয়শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর এবং সুবর্ণা মুস্তাফাকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে বড় ভূমিকায় অভিনয় করিয়ে নেওয়া দরকার। এই দুই শিল্পী বাংলাদেশ টেলিভিশনের দর্শকদের দশকের পর দশক মুগ্ধ করে রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। আবার সমাজের প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমানে যাঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন এবং করবেন বলে ভাবছেন, এই দুজনকে রাজি করিয়ে দেশের জন্য দেশের ইতিহাসকে নিপুণ গভীর সৃষ্টিশীলতায় ধরে রাখার একটা সুযোগ নিন, চেষ্টা করুন।

সম্প্রতি দেখলাম বদরুল আনাম সৌদের ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘গহীন বালুচর’। এই চলচ্চিত্রেও আমি অবাক বিস্ময়ে সুবর্ণাকে দেখেছি। যে সুবর্ণা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কমান্ডার’ চলচ্চিত্রে দুরন্ত ছটফটে এক তরুণ ফটোসাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যে সুবর্ণা হুমায়ূন আহমেদের রচনার নাট্যরূপে একের পর এক নরম–কোমল চরিত্রে দর্শককে বুঁদ করে রেখেছেন, সেই সুবর্ণা চরিত্রবিশেষে জাঁদরেল মহিলা, কড়া মেজাজি মানুষও হতে পারেন। একই মুখে এত রূপ; সুবর্ণাই যেন আস্ত একটা গহিন বালুচর। সুবর্ণা একটা অনবদ্য কবিতার খাতা, কবিতার মুখ।

‘গহীন বালুচর’ চলচ্চিত্রটির গল্পের মধ্যে একটা চিরন্তন গ্রামবাংলার লোককথা, লোকগল্প বা গীতিকাব্যের ধাঁচ আছে। এক ঠ্যাঙে একটা বক নদীর জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, এমন একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্যের মধ্য দিয়ে গল্পের মোচড়ের শুরু। ক্রমে বুঝতে পারা যায়, বক জলের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। নদীতে আসলে চর জাগতে শুরু করেছে।
নদীর ভাঙনের মতো এবার শুরু হয়ে যায় তীরবর্তী মানুষের জীবনের ভাঙা-গড়ার গল্প। দুই পারের মানুষ এই চরের জমিদখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে। অতীতেও জমিদখল নিয়ে দুই পারের মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ, রক্তক্ষয়, স্বজনহানি পর্যন্ত ঘটেছে। নদীর ভাঙনে জীবনের সবকিছু তলিয়ে যায়। চর জেগে ওঠার মধ্যেও মানুষের জীবনের স্বপ্ন নতুন করে জেগে ওঠে, সেই স্বপ্নের ঝিলিকে আগুনের ফুলকিও থাকে। জলের ওপর আগুন খেলার এ যেন এক অনবদ্য রূপকল্প। জলের সঙ্গে রক্ত মিশে যাওয়ার এক অভিজ্ঞান।

নদীর ভাঙা–গড়ার মতো তীরবর্তী মানুষের জীবনের প্রতি পদে লড়াই থাকে, প্রাণ থাকে, প্রেম থাকে। গভীর প্রেমের দৃশ্য বুননে পরিচালক বদরুল বেশ সিদ্ধহস্ত। চুম্বন থেকে জারিত ক্ষত বেশ দগ্ধকাতর। সেই প্রেম আবার পারস্পরিক বিবাদ, রাজনীতির কলহে জড়িয়ে ত্রিমুখী হয়। এই ত্রিমুখী প্রেমের পরিণতি বাংলার চিরন্তন লোকগাথার সুর বয়ে আনে।
এপারের ‘বিনা রক্তে না ছাড়িব সুচাগ্র মেদিনী’পক্ষের নেতা যদি হন আসয়া, অভিনয়ে সুবর্ণা মুস্তাফা। ওপারের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের নেতা তবে লতিফ শিকদার, অভিনয়ে রাইসুল ইসলাম আসাদ। দুই প্রবীণ অভিনেতা দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। সঙ্গে আবু হুরায়রা তানভীর, জান্নাতুন নূর মুন, নীলাঞ্জনা নীলা, ফজলুর রহমান বাবু, জিতু আহসান, শাহাদাৎ হোসেন প্রত্যেকের অভিনয় চমৎকার। আবার তীরবর্তী মানুষের জীবনপট, দৃশ্যসজ্জাও যথাযথ। আড়ালে থাকা এসব শিল্পীকেও জানাই কুর্নিশ। ক্যামেরার দৃশ্যধারণও বেশ ভালো।

তবে একটা বিষয় না বলে উপায় নেই, বদরুল বাংলাদেশের মানুষের জীবনছবি আঁকার চেষ্টা করলেও ছোটবেলা থেকে যে ধরনের বিদেশি বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র দেখে বেড়ে উঠেছেন, চেতনে–অবচেতনে তার প্রভাব কিন্তু কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ জায়গায় বদরুলকে একটু সচেতন হতে বলব।

একই কারণে এই চলচ্চিত্রের সুর পরিচালনা ভালো হলেও গানগুলো ঠিক মনে ধরেনি। গানের কথা এবং সুর দৃশ্য অনুযায়ী যেন জোর করে মেলানোর চেষ্টা হয়েছে। একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসেনি। লোককথার ধাঁচের গল্প, প্রচলিত কিছু লোকগান ব্যবহার করলেই বোধ করি আরও ভালো হতো। তবে সে ক্ষেত্রে নতুন গীতিকার–সুরকারদের একটু অবহেলা করা হতো। তাঁরা যদি নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ না পান, ভালো–মন্দ বুঝবেন কী করে। সেদিক থেকে সবার কাছে আরও প্রত্যাশা রইল।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত