সবুজের অভিযান

অলংকরণ: তুলি

সবুজ আনমনে গাছের ওপর বসে আছে। কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে ভাবছে ‘ইশ! যদি ভয়ংকর সুন্দর এই গহিন জঙ্গলের ভেতর থেকে ঘুরে আসতে পারতাম।’ মাঝেমধ্যে ভাবে, যদি পাখা থাকত, কতই–না মজা হতো। পাখির মতো উড়ে উড়ে এদিকে–সেদিকে যেতে পারতাম। কিছুক্ষণ পরপর সে ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে মাঠের গরুগুলোর ওপর চোখ রাখছে।

সবুজের বয়স সতেরো বছর। সুঠাম দেহের এক দুরন্ত বালক। বুকে অসীম সাহস, দুই চোখে অনেক স্বপ্ন। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা সংগ্রামী বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন। পাহাড়ে ঘেরা ঘন জঙ্গলের ভেতর তাদের ঘর। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় পরিবারসহ এখানে এসে আশ্রয় নেয়। রাঙামাটি শহর থেকে দূরে কাপ্তাই লেক পেরিয়ে দুর্গম পাহাড়ে। পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটা পরিবারের বসবাস। তারাও বাস্তুহারা। দূরে আরও কয়েকটা পাড়া আছে, যেখানে পাহাড়িদের বসবাস।

সবুজের বাবা সামাদ আলী পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে সাত-আট মাইল দূরের বাজারে নিয়ে বিক্রি করে। সমতল কিছু জমিতে ধান চাষ ও মৌসুমি শাকসবজির চাষ করে। বাস্তুহারা বলে কিছু সরকারি সাহায্যও পায়। মা–বাবা ও এক বোন নিয়ে সুখেই দিন কেটে যাচ্ছে। তারা গরু-ছাগল পালন করে, সবাই মিলে সেগুলো দেখাশোনা করে। সবুজ জঙ্গলে গরু চরাতে নিয়ে যায় আর ঘরের কাজে সাহায্য করে। মা বেশ পরিশ্রমী। হাঁস-মুরগি পালন করে, বাড়তি কিছু আয় হয়। পরিবারটির চাওয়াপাওয়াও সীমাবদ্ধ, অল্পতেই সন্তুষ্ট।

একটা পোষা কুকুর আছে। সামাদ আলী একদিন বৃষ্টিতে ভিজে বাজার থেকে ফেরার পথে কুকুরছানাটি কুড়িয়ে পেয়েছিল। ছানাটি বৃষ্টিতে ভিজে যায় যায় অবস্থা। কুকুরছানা পেয়ে সবুজ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। সে রাত-দিন সেবাযত্ন করে কুকুরটিকে সুস্থ করে তোলে। তাদের জীবন কঠিন সংগ্রাম করে চলছে, তারপরও কুকুরটির জন্য অনেক মায়া। সবুজ কুকুরটির নাম রেখেছে মতি। তার খুবই প্রিয়। যেখানে সে যায় সঙ্গে মতিও যায়। জঙ্গলে একা চলতে গেলে মতি থাকলে সবুজের বুকে সাহস জাগে।

প্রতিদিনের মতো গরুগুলোকে মাঠে রেখে সবুজ ও মতি পাশাপাশি হাঁটছে। হঠাৎ যমদূতের মতো সামনে একটি চিতা বাঘ এসে উপস্থিত। সবুজ ভয়ে অস্থির, মতি বাঘটির সামনে গিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে। অন্যদিকে সবুজ একটি লাঠি নিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে করতে একপাশে চলে আসে। বাঘটি মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে মতির ঘাড়ের ওপর। মতি কৌশলে সরে পড়ে চিতা বাঘটির সঙ্গে লড়তে লাগল। এবার বাঘ সুযোগ বুঝে সবুজের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে ভয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাঘ আর সবুজের দূরত্ব এক হাতের কম। চিতা বাঘ যেই কামড় দেবে, তখন মতি বাঘের পা কামড়ে ধরে। সুযোগ বুঝে সবুজ মাটি থেকে উঠে দিল এক দৌড়। বিদ্যুৎ বেগে ছুটে ঘরে এসে ঢুকল।

মাকে বলল, ‘মা আমাকে পানি দাও।’ সে ঢক ঢক করে সব পানি পান করল। মা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কেন এমন করছিস? কী হয়েছে, ভয় পেয়েছিস?’
হাঁপাতে হাঁপাতে সে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।
‘তুই ঘর থেকে বের হলে আমার মনও তোর সঙ্গে বাইরে থাকে। সব সময় তোর সুরক্ষার জন্য দোয়া করি। পোড়া কপাল, সর্বনাশা নদী আমাদের সব ভেঙে নিয়ে গেছে। তাই আজ আমরা এই জঙ্গলে বাঘের সঙ্গে লড়াই করছি। তোর যদি আজকে কিছু হয়ে যেত, তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচতাম।’ এসব বলে মা আহাজারি শুরু করল।

কিছুক্ষণ পরে মতি বীরের বেশে ফিরে এল। সবুজের গায় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কুই কুই করে ডাকতে লাগল। তার সারা শরীরে আঁচড়ের দাগ। ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরছে। সবুজ মতিকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। মতিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বের হয়ে পাহাড়ি লতাপাতা দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিল।

সহসভাপতি, রাউজান বন্ধুসভা