বই আলোচনা: ইছামতী
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘ইছামতী’। এটি নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহ নিয়ে রচিত। একসময় এই বাংলায় নীল চাষ হতো এবং খ্যাতি ছিল পুরো বিশ্বজুড়ে। প্রাকৃতিক এই নীল চাষ করা হতো ফসল চাষের উপযোগী উর্বর জমিতে। এতে করে জমির উর্বরতাশক্তি নষ্ট হতো। তাই অনেক কৃষক তাঁর জমিতে নীল চাষ করতে চাইতেন না। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে নীল কুঠির কর্মচারীরা কৃষকদের বাধ্য করতেন নীল চাষ করতে।
পরবর্তীকালে নীল চাষ বন্ধ হলেও এ দেশের মানুষের ভাগ্য খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কর্মদক্ষতায় অনেকের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তন করলেও অনেক মানুষ আগের মতো থেকে যায়। তারা নিজের উন্নতি করতে চেষ্টা করে না, আবার অন্যের উন্নতিও দেখতে চায় না। প্রকৃতির রূপ বদলায়, মানুষের অভ্যাস বদলায়, শুধু বদলায় না বাইরের দৃশ্যমান কিছু লোকদেখানো সামাজিকতা।
ইছামতী উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর একটি ভবানী বাড়ুয্যে। যার অবস্থান গ্রামের মানুষদের মধ্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। ঈশ্বরকে স্বচক্ষে না দেখলেও গ্রামের মানুষ তাঁকে ঈশ্বর সমতুল্য সম্মান করত। ভবানী একসময় সন্ন্যাস গ্রহণ করে বনে চলে যান। গুরুর আদেশে আবার চলে আসেন জনজীবনে। কুলীন বংশের রাজারাম রায়ের তিন বোন তিলু, বিলু ও নীলুকে একত্রে বিয়ে করে সংসারী হন। কুলীন বংশে আগে এমন নিয়ম প্রচলিত ছিল। বউদের ভাইয়ের দেওয়া জমিতে ঘর তুলে সংসার শুরু করেন ভবানী। তাঁদের সংসার আলো করে আসে খোকা টুলু, ভালো নাম রাজেশ্বর। সংসারের নানা টানাপোড়েনে এই খোকাকে নিয়েই চলে তাঁদের সুখের স্বর্গ।
ভবানী ঈশ্বর জ্ঞান, ভগবত পাঠ, জীবন ও ধর্ম সমন্বয়, দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় ধ্যান করা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এ গ্রামে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার মতো লোক পাওয়া মুশকিল। দারিদ্র্যে জর্জরিত মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তাই ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে মানুষের সঙ্গে এসব জ্ঞানমূলক আলোচনা নিছক ব্যর্থতা।
কবিরাজ রামকানাই তাদের মধ্যে ভিন্ন। ভবানী তাঁর সঙ্গে এসব ঐশ্বরিক জ্ঞানের আলোচনা করতে পারেন। অর্থের মোহ আর পরনিন্দা করা ছাড়া ব্যক্তির তালিকায় রয়েছেন এই রামকানাই কবিরাজ। নিকটবর্তী কয়েক গ্রামে তাঁর নামডাক রয়েছে। অর্থের অভাবে কেউ তাঁর কাছে চিকিৎসা পায়নি, এমন নজির গ্রামের কেউ দেখাতে পারবে না।
গ্রামে একসময় অবস্থাশালী লোকের মধ্যে রাজারাম অন্যতম। সম্পত্তি নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল চরম। নীল কুঠিতে কাজের সূত্রে কয়েক গ্রামের লোক তাঁকে মান্য করত। প্রতিদিন মজলিশে বিভিন্ন মানুষের আনাগোনা হতো। জমির সমস্যা, চাষের সমস্যা, পারিবারিক ও সামাজিক বিচার–আচার করে গ্রামের মাথা হয়েছিলেন তিনি। ঘরে তিন বোন ছাড়াও ছিল একমাত্র বউ। কোনো সন্তান ছিল না তাঁর। তবু অর্থের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন সব সময়। মানুষের ওপর বিভিন্ন সময় বিনা কারণে অত্যাচার করতেন। নীল বিদ্রোহের সময় কয়েক গ্রামের মানুষের আক্রমণে প্রাণ দিতে হয় একসময় শাসন করা এই রাজারামকে।
নালু পালের চরিত্র নিজ কর্মের বিশ্বাসে ভাগ্য পরিবর্তনের। একসময় নালু পাল মামার বাড়িতে থাকত, সেখানেই বড় হওয়া। কোনো কাজে পান থেকে চুন ঘসলেই মামিরা নানা কথা শুনাত। কথায় কথায় অন্ন ধ্বংস করার কথা বলত। কৈশোরে শখ করে বাবরি চুল রেখেছিল। সে জন্য মাথায় তেল বেশি দেওয়া নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে এই নালু পালকে। গ্রাম থেকে মাথায় করে অল্প অল্প জিনিস হাটে বিক্রি করে আয় করা শুরু করে নালু পাল। ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করে। গ্রামের ছোট মুদিদোকান থেকে একটা সময় আড়ত দেয় সে। অংশীদারত্বে ব্যবসা বাড়ায়। অবস্থার পরিবর্তন হয় নালু পালের। সংসারে মা আর এক বোন। বিয়ে করে তুলসী দেবীকে ঘরের লক্ষ্মী করে আনে।
নালু পালের অবস্থা পরিবর্তন হওয়াতে সে তার বউয়ের ইচ্ছায় মাঝেমধ্যে ব্রাহ্মণদের ভোজন করায়। কিন্তু সেটা তাদের বাড়িতে নয়, ভবানী বাড়ুয্যের বাড়িতে। কারণ, পাল বংশের কারও বাড়িতে ব্রাহ্মণেরা খাবেন না, এটাই রীতি ছিল। একবার রীতি ভেঙে নালু পাল নিকটবর্তী গ্রাম থেকে ১০০ ব্রাহ্মণ এনে ভোজন করায়। এমনকি পরে যখন নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়, তখন এই নালু পাল ব্যবসায়ী নীল কুঠি কিনে রাখে। একসময় দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে অন্যের গলগ্রহে বড় হওয়া নালু পাল কাজ আর বুদ্ধির জোরে অবস্থার পরিবর্তন করে সমাজে গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়।
নীল কুঠিতে নীল চাষের জমি নিয়ে হাঙ্গামা হয়। বড় সাহেব শিপটন, আমিন প্রসন্ন চক্কতি ও গয়া মেম—এই তিন চরিত্রের প্রেম–বিরহ, মান-অভিমান ও জীবন নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় উপন্যাসের বিভিন্ন পাঠ রচিত হয়। নীল কুঠির ভালো অবস্থা থাকাকালে গয়া মেমকে বড় সাহেব যত্নে রাখতেন। সোনা–গয়নাসহ অনেক কিছু দিতেন। গয়া মেমকে বড় সাহেব খুব ভালোবাসতেন, গয়া মেমও। কিন্তু কখনোই গয়া মেম বড় সাহেবের সঙ্গে এই নীল কুঠিতে রাত কাটাননি।
প্রসন্ন চক্কতি গয়া মেমকে মনে মনে ভালোবাসত। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু সাহস করে বলতে পারত না বড় সাহেবের খাতিরের লোক বলে। যখন বড় সাহেব মারা যায়, তখন প্রায়ই নিজের মনের কথা নানাভাবে প্রকাশ করত গয়ার কাছে। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। গয়া মেম ঠাট্টার ছলে সব কথা উড়িয়ে দিত।
নীল কুঠি বিক্রি হয়ে গেলে প্রসন্ন চক্কতি কাজের সূত্রে বহরামপুর চলে যায়। পরে যখন গয়ার সঙ্গে দেখা হয়, তখন গয়াই তাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে বলে, সংসার করতে অনুরোধ করে। কিন্তু প্রসন্ন চক্কতি কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। এভাবে জীবনের চক্রে তিনজন আলাদা হয়ে জীবন পাড়ি দেয় আপন আপন বৈশিষ্ট্যে।