পুনরাবৃত্তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মীর আজমল খানের বাসা। কান পাতলেই যে কেউ আজ মীরের বউ সাইদা খানের কান্না শুনতে পাবে। গত ৫০ বছরের ইতিহাসে এ তল্লাটে সাইদা খানের গলার আওয়াজ কেউ শুনেছে বলে স্মরণ করতে পারে না। একমাত্র সন্তান ক্যানসারে মারা যাওয়ার পরও কেউ তাকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি। পাষাণভার সাইদা খানের কান্না মহল্লাবাসীকে যারপরনাই ব্যথিত করল। স্বামী মরলে কে না কাঁদে!

সকালে উঠে ভদ্রমহিলা আবিষ্কার করলেন, মীর আর নেই। ঝুলে আছে ফ্যানের সঙ্গে। এভাবে মারা যাওয়ার কোনো কারণই ছিল না। ৮০ বছরের একটা মানুষ আর কতদিনই–বা বেঁচে থাকত। গড় আয়ুর হিসাব করলেও সেটা অনেক আগেই গত হয়েছে। এই চিন্তা থেকেও একজন মানুষের এ রকম ঝুলে পড়া ঠিক নয়। তবে মীর যে মারা যাবে, এটা ভদ্রমহিলা আগেই বুঝতে পেরেছিল। প্রতিবেশীরা বুঝতে পারল সকালে; বিলাপের সারাংশ বিশ্লেষণ করে।

সময় ঘনিয়ে এলে মানুষ বুঝতে পারে। মীর সাহেবও ব্যতিক্রম নন। মৃত্যুর মাসখানেক আগে থেকেই প্রিয় জিনিসগুলো আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিলিয়ে গেছে। জেলা সদরের সেটেলমেন্ট অফিস থেকে জায়গাজমির যাবতীয় সমস্যার ফয়সালা করে গেছে। খাঁচা থেকে যেদিন শখের বাজরিগর পাখিটা ছেড়ে দিল, সেদিনই মোটামুটি আঁচ করা গেল তিনি ইহজাগতিক বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে বিপত্তিটা ঘটিয়েছে আজরাইল ফেরেশতার জন্য অপেক্ষা না করে। মৃত্যু নিয়ে থানা-পুলিশে ছোটাছুটিও সাইদা খানের একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। গোদের ওপর বিষফোড়া হিসেবে আছে ময়নাতদন্তের ঝামেলা। তবে দুপুর গড়ানোর আগেই দেবরের ছেলেরা ত্রাণকর্তা হয়ে এই সমস্যার সমাধান করে। বিপদেই তো আত্মীয়স্বজনদের চেনা যায়।

জানাজার পরে শেষ হয়েছিল সাইদা খানের রোনাজারি। প্রতিবেশীরা বুঝল পাষাণভার এই ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত; যার ঘরে স্বামী ও ছেলে নেই, তারই এমন কান্না সাজে। কেউ হয়তো একটু শক্ত হতে বলেছিল সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে। জগতের কিছু বিপত্তি মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়। অতীতের কোনো মৃত্যু হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। ৫০ বছর আগে এ রকম ঝুলে পড়া একজন মানুষের জানাজা বাদেই কবর দেওয়া হয়েছিল। কিতাবে এ রকম মানুষের জানাজার খবর সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজও মনে হয়, ঠিক যেন চরের কোমল বালুতে শরতের কাশফুলের মতো শুভ্র একটি মানুষকে পুঁতে ফেলা হলো। তিনি ছিলেন সাইদা খানের বাবা।

মহেশপুর, ঝিনাইদহ