স্মৃতির ঝাঁপি থেকে পটিয়া বন্ধুসভার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি আয়োজন

২০০৬ সালে পটিয়া বন্ধুসভার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি আয়োজনছবি: লেখকের সৌজন্যে

সময়টা ছিল ২০০৬ সাল। চট্টগ্রাম জেলা বন্ধুসভায় কাজ করতাম। পটিয়া বন্ধুসভার সবে অভিষেক হয়েছে। পটিয়ার প্রথম আলো প্রতিনিধি রাজ্জাক ভাইকে বলে পটিয়া বন্ধুসভার বন্ধুদের নিয়ে আমার পরিকল্পনায় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধদিনের গল্প শুনি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। উপজেলার কর্ণফুলী কমিউনিটি সেন্টার কোনো এক পৌষের বিকেলে পটিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম শোনান যুদ্ধদিনের গল্প। উনাকে আমি চাচা বলে সম্বোধন করতাম।

১৯৭১ সাল। দেশব্যাপী যুদ্ধ চলছে। এক রাতের অন্ধকারে আবুল কালাম চাচা বাড়ি থেকে বের হন। বের হয়েই পড়লেন বিপদে। তাঁর দাদা কালা মিয়া সওদাগরকে সবাই ভয় পেত। উনার ভয়ে বাসা থেকে কেউ বের হতো না। এদিকে শহীদ ছবুর শিস দিচ্ছেন বের হওয়ার জন্য। বাড়ির পালা কুকুর টমি ঘেউ ঘেউ করছে। দাদা ঘুমাননি। হঠাৎ দাদা গলা খাঁকারি দিয়ে চিৎকার করে ডাক দিলেন, কে কে। বাইরে এসে হারিকেন দিয়ে দেখছিলেন কোনো চোর-ডাকাত এল কি না! দাদা চিৎকার করে বললেন, ‘খবরদার দেশের পরিস্থিতি ভালো না। কেউ ঘর থেকে বাইর হবি না। এই কালাম ঘুমিয়ে পড়। তুই জেগে আছিস কেন?’

সেই রাতে শহীদ ছবুর বাড়ির কুকুর যাতে ঘেউ ঘেউ করতে না পারে, সে জন্য কুকুরের পায়ুপথে লাঠি দিয়ে গরম ডালডা লাগিয়ে দেন। এরপর টমিকে কিছু পাউরুটি খেতে দেওয়া হলো। অন্ধকারে একটা কাপড়ের পোঁটলা নিয়ে কান্ডারি দলের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বের হয়ে যান কালাম চাচা। পরদিন তাঁকে সবাই খুঁজতে লাগল। পরে জানতে পারে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। ২২ বছরের টগবগে তরুণ কালাম চাচা বেশ কয়েক মাস পর যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে আসেন।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চৌধুরী মাহাবুব বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রামগড় হয়ে অধ্যাপক এ বি এম সামসুল ইসলামের (প্রথম গ্রুপ কমান্ডার) নেতৃত্বে দেশে ফিরে আসি। ফেরার পথে চোখে পড়ে খালের পানিতে লাশ ভাসছে। সেই দৃশ্য দেখে কালাম, শহীদ ছবুর, আসলাম, রফিক, আহমেদ কবিরসহ সবাই প্রতিশোধের আগুনে ফুঁসে উঠি। সবাই মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করি।’

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একসময় দেশ স্বাধীন হয়। সহযোদ্ধারা, আহমেদ কবির, কবিয়াল এস এম নুরুল আলম, চৌধুরী মাহাবুবুর রহমান, সুনিল জলদাস, আবুল বাশারসহ আরও অনেকে বাড়ির সামনে এসে আনন্দ করছে, আকাশের দিকে বন্ধুক তাক করে ফাঁকা ফায়ার দিতে থাকে। বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে যায়। কালাম চাচার মুখভর্তি দাড়ি, মাথাভর্তি বাবরি চুল দেখে কেউ চিনতে পারছিল না। কালাম চাচা দাদাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন। দাদা ধমক দেন কে আপনি? কালাম চাচা বলেন, ‘দাদা আমি আপনার নাতি। তখন বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকেন। কোথায় ছিলি এত দিন ভাই আমার? তোর জন্য বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির।’

হঠাৎ কালাম চাচা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, বিষাদের স্মৃতিও আছে। যুদ্ধ শেষে একদিন কেলিশহরে রাজাকার অপারেশনে যাওয়ার কথা। সেদিন নাকি দুপুরবেলা সহযোদ্ধা শামসুদ্দিনের মিস ফায়ারে গাজী ছবুর শহীদ হন। গাজী ছবুর শহীদ হওয়ার কথা শুনে কালাম চাচা চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি করে ভেঙে পড়েন। শহীদ ছবুর উনার প্রিয় বন্ধু ছিলেন। কালাম চাচাদের বাড়ির পুকুরপাড়ে ১৯৫৬ সালের তৈরি বিশাল ঘাটলা। পটিয়া সদরের ’৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত সবচেয়ে বড় পকুরের ঘাটলা। এই ঘাটে বসে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে পরামর্শ করতেন। যুদ্ধকালীন সময়ে কোনো এক রাতে ঘাটে বসে মুক্তিযোদ্ধা কালাম, আহমেদ কবির, শহীদ ছবুর, কবিয়াল এস এম নুরুল আলমসহ আরও অনেকে গোপন বৈঠক করছিলেন। ঠিক ওই সময় এলাকার মুসলিম লীগ–সমর্থিত মরহুম আবদুল জব্বার হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। কালাম চাচা তাঁকে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘কে আপনি? হারিকেন ছোট করেন। আপনি জানেন না চারদিকে পাকিস্তানি বাহিনী।’ তিনি হারিকেন ছোট না করায় রেগে গিয়ে লাথি মেরে হারিকেন ভেঙে ফেলেন। কালাম চাচা শুধু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন একজন ন্যায়বিচারকও। চাচা এখন দুনিয়ায় নেই। আছে শুধু তাঁর যুদ্ধদিনের গল্প।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা